ফেলানিদের গল্প

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ–বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মেয়ে দুটির মাথায় উকুন হয়েছে। পেটে ভাত নেই, শখ কত! বড় চুল রাখবে। ফেলানি বেগম রাগ করে ব্লেড দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। খিদের চেয়ে চুলের শোকে মেয়ে দুটিকে বড় বেশি ক্লান্ত লাগছে। কদিন হলো পেটে ভাত পড়েনি। পাশের বাগানে আঠিয়া কলার ছড়ি পেয়েছে, রাতের ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল। আপাতত কলা খেয়ে দিন কাটছে।

খিদের জ্বালায় একেকটি বাড়ি যেন মৃত্যুপুরী। অবুঝ শিশুর করুণ আর্তনাদে স্তব্ধ আকাশ–বাতাস। ফেলানি বেগম রাগে, ক্ষোভে যা–তা বলে গালি দিচ্ছে স্বামী সন্তানদের। ভেতরে ভেতরে বুক ফেটে যাচ্ছে দুটো ভাত মুখে তুলে দিতে পারছে না এই শোকে।

প্রতিটি রাতে এখন ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ২০১৭ সালের বন্যায় হাবুডুবু খেয়েছে। ওইবার টুনু মিয়ার বাইরের গোয়ালঘরে ঠাঁই হয়েছিল। এবার কী হবে? প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যায়, উত্তর মেলে না। আসুক বৃষ্টি, সবকিছু ডুবে যাক। ডোবাক আমাকে। সবাই ডুবে মরব। খিদের জ্বালায় মরার চেয়ে ডুবে মরা ঢের ভালো।

টিভিতে বলছে, জনসাধারণ যত সব মূর্খ, বর্বর। খাবার পেটে থাকলে ইচ্ছে করে কেউ মূর্খতা করবে না। ক্ষুধার স্বাদ, ঘ্রাণ, লক্ষণের চেয়ে কোভিড-১৯–এর লক্ষণ ফেলানিদের কাছে মারাত্মক নয়। খিদে উছলে উঠছে। ফেলানি লড়াই করছে তার ভাগ্যের সঙ্গে, সোনার বাংলার সঙ্গে, ঝড়ের বেগে আক্রমণকারী কোভিড-১৯–এর সঙ্গে। সারা রাত ঘুমোতে পারে না। বাচ্চা তিনটির মুখের দিকে দ্যাখে আর কাঁদে ফেলানি বেগম।

দুটো ত্রাণের প্যাকেট পেয়েছিল, শেষ হয়ে গেছে সেই কবেই। হাত ধোয়ার সাবান কেনারও টাকা নেই। মেম্বারের বাড়ি গেলে বলে আর কত চাস? কে একজন বলল, বাইরে বের হও। বাচ্চটার নাক মুছে দে। নাকমুখে ঢুকে যাচ্ছে আর চেটে চেটে খাচ্ছে। ওয়াক থু। যা বাইরে যা। মেম্বার বাড়িতে আসুক, বলব। টাকা জোগাড় করে রাখতে পারিস নাই। এত দিন কাজ করছিস? কী করব! স্বামী প্যারালাইজড হওয়ার পর সব টাকা ওর ওষুধপথ্যে চলে গেছে। এখন বাকি ঘরের দরজা আর জানালা। একটা বড় বাক্স ছিল, সেটাও বিক্রি করে দিয়েছি। মোটের ওপর ৩৫০ টাকা পেয়েছি। যা দিয়ে ওষুধ কিনেছি। ফেলানিদের বাক্স তো নিলামে বিক্রি হবে না!

ফেলানিরা আজ বেকার। কেউ কাজে নিচ্ছে না। ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। আগে ফেলানি কাজ করতেন। বাচ্চাগুলো প্রাইমারি স্কুলে যেত। বিস্কুট পাইত। এখন স্কুলও বন্ধ। সব বন্ধ। খিদের জ্বালা বন্ধ হয় না। ছোট ছেলেগুলো এলাকার নেতা। ওরা একেকজন একেকবার আসতেছে আর ভোটার আইডির ফটোকপি ও ছবি নিয়ে যাচ্ছে। তিনটে ছবি ছিল। আজ থেকে ছবিও শেষ। আর কত দিন! মোবাইলে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ২০ টাকা দিয়ে খোলা হয়েছে। টাকা যে কবে আসবে? প্রতীক্ষার পালা কবে শেষ হবে কে জানে?

মাথায় একটা ধান্দা এসেছে ফেলানির। গাবুরার রাস্তার ধারে অনেক টমেটো পড়ে থাকে। ট্রাক লোডের সময় অনেকগুলো রয়ে যায়। ওগুলো কুড়িয়ে এনে কাল সবাই মিলে খাব। আর ধান কাটার কাজ নেব। কিন্তু টাকা তো দেবে না ধান কাটলে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধান কেটে দিচ্ছে। তবুও দেখি কাজ করে দিলে যদি মুড়ি–টোস্ট খেতে দেয়! তাহলে তো কয়েক দিন চলবে...।

রমজান মাস এসে গেল। রোজার দিনগুলো কীভাবে কাটবে আল্লাহ মালুম। ইফতার দূরের কথা! আগে মসজিদে ইফতারি দিত, এবার তো তা–ও বন্ধ।

*লেখক: সহকারী শিক্ষক, ঝানজিরাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিনাজপুর সদর