করোনায় বরিশালে সাড়ে ১৯ লাখ শিশুর টিকাদান কার্যক্রম স্থবির

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বরিশাল বিভাগের শিশুদের ইপিআই ও হাম–রুবেলার টিকাদান কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ শিশুর জটিল সব রোগব্যাধির টিকাদান অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। অত্যাবশ্যকীয় এসব টিকা শিশুদের একটি নির্ধারিত বয়সের মধ্যেই দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, করোনার আতঙ্কে টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় মায়েরা শিশুদের নিয়ে আসছেন না। স্বাস্থ্যকর্মীরা সপ্তাহের নির্ধারিত চার দিন টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় উপস্থিত হলেও মায়েদের সাড়া না পাওয়ায় আপাতত টিকাদান কার্যক্রম স্থগিত রাখারও দাবি তুলেছেন তাঁরা।

তবে বরিশালের সিভিল সার্জন মনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের নির্দেশনা আছে যে এই কর্মসূচি কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। তা ছাড়া সঠিক সময়ে শিশুদের টিকা না দিলে এসব টিকার কার্যকারিতা থাকে না।

স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, ইপিআই কার্যক্রমের আওতায় শিশুর জন্মের পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বিসিজি টিকা নিতে হয়। এই টিকা যক্ষ্মা রোগ থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়া হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে তিন ডোজে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া হয়। পোলিও রোগ প্রতিরোধে জন্মের পর থেকে ২ মাসের মধ্যে প্রথম, ৪ মাস বয়সে দ্বিতীয়, ৬ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে তৃতীয় ডোজ এবং ৪ থেকে ৬ বছর বয়সের মধ্যে শেষ ডোজ দিতে হয়। টিটেনাস, ডিপথেরিয়া ও হুপিং কাশি, রোটা ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম–রুবেলা, চিকেন পক্স, হেপাটাইটিস এ ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে জন্মের পর থেকে কয়েক মাসের মধ্যে অন্তত ১১টি টিকা বিনা মূল্যে শিশুদের দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার ৩৫২টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে ২৪টি করে অস্থায়ী কেন্দ্রে শিশুদের এসব টিকা দেওয়া হয়।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ১৮ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপে বিভাগের ১৯ লাখ ৫০০ (৯ মাস থেকে ১০ বছরের নিচে) শিশুকে হাম-রুবেলা টিকাদান কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে ১৫ মাস বয়সী শিশুর সংখ্যা ২ লাখ ১৫ হাজার।

স্বাস্থ্য সহকারীরা বলেন, সপ্তাহে চার দিন মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্য সহকারী ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের এই কাজ করতে হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর এই কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকার বাক্স নিয়ে গেলেও উপস্থিতি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এতে স্বাভাবিকের তিন ভাগের এক ভাগ শিশুকেও টিকা দিতে পারছেন না তাঁরা। তাঁরা জানান, জন্মের পর থেকে ১৫ বা সর্বোচ্চ ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে জীবন রক্ষাকারী ১০টি টিকা দিতে হয়। এই টিকা দিলে শিশুর কখনো জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। করোনাভাইরাসের উপসর্গ জ্বর হওয়ায় সেই আতঙ্কে মায়েরা এখন আর টিকাদান কেন্দ্রে আসতে চান না।

স্বাস্থ্য সহকারীরা বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়ে মায়েরদের ডেকেও আনা যায় না। অন্যদিকে, অস্থায়ী কেন্দ্র বসানো বাড়ির মালিকেরাও তাদের বসতে দিচ্ছেন না। এতে তাঁদের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য সহকারীরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা চাইছেন, চলমান দুর্যোগে টিকা প্রদান কর্মসূচি বন্ধ রাখা হোক।

বরিশাল সদরের কড়াপুর ইউনিয়নের রায়পাশা ওয়ার্ডের স্বাস্থ্যকর্মী তরুণ দাস মুনশি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আওতয় ৮টি কেন্দ্র আছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তহে দুটি কেন্দ্রে কোনো শিশুই আসেনি। মায়েরা বলেন, বাচ্চাদের জ্বর উঠে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আপনারা দায়িত্ব নেবেন? আবার এসব কেন্দ্র যেসব বাড়িতে, সেসব বাড়ির লোকেরা আমাদের কেন্দ্র পরিচালনা করতে দিচ্ছেন না। বনে-বাগানে বসে কেন্দ্র চালাতে হয়। তারপরও ৭০ ভাগই অনুপস্থিত। আপাতত এই কার্যক্রম বন্ধ রাখলে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, এক বছর বয়সের মধ্যে এই টিকা দিলে এর কার্যকারিতা অক্ষুন্ন থাকে।’

স্বাস্থ্য সহকারী অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল সদরের চড়বাড়িয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকর্মী জিয়াউল হাসান বলেন, বরিশাল বিভাগে ৮ হাজার ৪৮৪টি অস্থায়ী কেন্দ্র আছে। সব কেন্দ্রেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে টিকাদানের হার তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সপ্তাহের চার দিন স্বাস্থ্য সহকারীদের কেন্দ্রে হাজির হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য হলেও এই কার্যক্রম স্থগিত রাখার দাবি জানান তিনি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যমাল কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার আতঙ্কে টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় উপস্থিতি কমে গেছে, এটা আমরাও শুনেছি। তবে এই কার্যক্রম চলমান না রেখে বিকল্প নেই। কারণ নির্ধারিত বয়স বা সময়েই এসব টিকা শিশুদের দিতে হবে। অন্যথায় সেগুলো কার্যকারিতা হারাবে। এখন অভিভাবকদের সচেতন করে হলেও কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যকর্মীদের করতে হবে। আমরা সে বিষয়ে নির্দেশনা দেব।’