লকডাউনে বাবা-মেয়ের আলাপন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ছেলেমেয়ে দুটোকে মোটেও সময় দিতে পারি না, সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া। ওই একটি দিন ওদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করি, খোঁজখবর নিই নানা বিষয়ে। ক্লাসের পড়াশোনার বাইরে ছেলেটা ব্যস্ত থাকে মোবাইল, ল্যাপটপ আর ক্রিকেট নিয়ে। ব্যতিক্রম মেয়েটা। সব সময় পড়ে থাকে পড়াশোনার ভেতরে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি রূপ ধারণ করলে লকডাউনের মধ্যে ঘরে থাকতে বাধ্য হই। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। বন্দিজীবনের একঘেয়েমি কাটাতে ওদের সঙ্গ দেওয়া শুরু করি।

একদিন পেপার পড়তে পড়তে মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠল, ‘বাবা, একটা জিনিস খেয়াল করেছ! করোনাভাইরাসের টেস্টের মতোই করোনাকালেরও দুটো দিক আছে। তবে সেটা টেস্টের নেগেটিভ ও পজিটিভের ঠিক বিপরীত।’ ওর কথার ধরন বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলাম,‘কী রকম?’ তারও পাল্টা প্রশ্ন, ‘আগে নেগেটিভ বলব না পজিটিভ?’ বললাম, ‘নেগেটিভগুলোই আগে বলো।’ ‘শোনো তাহলে, পৃথিবী আজ বড়ই অরক্ষিত, প্রকৃতির ওপর আমরা এতই অত্যাচার করেছি যে সে হয়তো তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। এক ভাইরাসের কাছে রাজা, প্রজা, আমির, গরিব সবাই অসহায়। দম্ভ, দাপট, ক্ষমতা, শক্তি, কোনো কিছুই কাজে আসছে না। শক্তিধর দেশগুলোও বড় অসহায়।

বাড়িতে থাকা, সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন, এগুলো না মানায় মৃত্যু যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে হতাশাও। ভোগ্যপণ্য চলে যাচ্ছে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। দারিদ্র্যের কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়বে, এ কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও বেড়ে যাবে। ১৫৪ কোটি শিক্ষার্থী পারফরম্যান্সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে কৃষক, খামারি, কৃষি খাত, শিল্প খাত, মৎস্য খাত, পোশাক খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্য। করোনাকেন্দ্রিক গুজবের ডালপালা ও স্ববিরোধী কথাবার্তা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিশাল মন্দার মধ্যে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। এই নিষ্ঠুর মানবজাতিকে তুড়ি মেরে যথেষ্ট শিক্ষা দিচ্ছে এক অদৃশ্য জীবাণু। প্রকৃতিপ্রেরিত মারণাস্ত্র আমাদের পরিশুদ্ধির এক চরম বার্তা দেখিয়ে দিচ্ছে।

এসব কথা শোনার পর আমি বললাম, ‘এবার তাহলে পজিটিভ দিকগুলো বলো!’ সে তার কথা বলতে শুরু করল, কোভিড-১৯ সবাইকে থমকে দিয়ে একই ছাতার নিচে দাঁড় করিয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর এমন সম্মিলিত প্রচেষ্টা সুদূর অতীতে আর দেখা যায়নি। বিশেষ করে চিকিৎসাব্যবস্থা বড় ধাক্কা খেয়ে দেখিয়ে দিল যে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই।

মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ যাবতীয় সামাজিক অপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। জনসমাগম, কোলাহল, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনার আপাত সমাপ্তি ঘটেছে। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, দুর্নীতিও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলদূষণ না থাকার এই সুযোগে প্রকৃতি যেন নিজেকে নতুন রূপে সাজিয়ে নিচ্ছে। করোনাকালের এই সময়ে গোটা বিশ্ব এক ‘অভয়ারণ্যে’ পরিণত হওয়ার কারণে প্রাণিকুলের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। সাগর, নদী বা জলাশয়ে তার প্রমাণও মিলেছে।

মেয়ে বলেই চলেছে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহারের প্রবণতা মানুষের মধ্যে সুস্থ থাকার প্রবণতা তৈরি করবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় বা মহামারি মোকাবিলায়, ঘরে থাকা, নিরাপদে থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার এই প্রচেষ্টা সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করবে অদূর ভবিষ্যতেও। হয়তো তত দিনে করোনা নামক ভাইরাসটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, বুঝলে বাবা!