করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসক ১৮ দিন আইসিউতে, এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক অনিুল কুমার বসাকের বয়স ৬৫ বছর। এক মাস আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয় টানা ১৮ দিন। পরে অবস্থা ভালো হওয়ায় তাঁকে আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষায় ফলাফল আসে করোনা নেগেটিভ। গতকাল বৃহস্পতিবার ছাড়া পেয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক।
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক সিনিয়র কনসাল্টেন্ট অনিল কুমার বসাক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, 'করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আমার শারীরিক অবস্থা এত খারাপ হয় যে, আমি হাঁটতে পারতাম না। আমাকে আইসিউতে রাখা হয় টানা ১৮ দিন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আমি এখন আমার পরিবারের সঙ্গে আছি। আমি এখন সম্পূর্ণ।'
করোনাজয়ী চিকিৎসক অনিল কুমার জানান, তাঁর মেয়ে নিলীম বসাকও চিকিৎসক। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর মেয়ে নিলীমা হাসপাতালেই বাবার সেবাযত্নের জন্য ছিলেন। যদিও মেয়েকে সেখানে থাকতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিষেধ করেছিলেন।
চিকিৎসক নিলীমা বসাক প্রথম আলোকে বলেন, 'বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা আমাকে হাসপাতালে থাকতে বহুবার মানা করেছিলেন। কিন্তু আমি আমার বাবাকে ছেড়ে আসতে চাইনি। হাসপাতালে থেকে যতটুকু পেরেছি বাবাকে সেবাযত্ন করেছি। আমি খুব ভাগ্যবান যে, আমার বাবা করোনাকে জয় করে বাড়ি ফিরতে পেরেছে। আমি আনন্দিত। করোনা হাসপাতালে প্রায় একমাস থাকার পরও আমার কিন্তু করোনা পজিটিভ আসেনি।'
পাঁচ বছর আগে অনিল কুমার বসাক ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে সিনিয়র কনসাল্টেন্ট পদে থাকা অবস্থায় অবসারে যান। এরপর নারায়ণঞ্জের একটি বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন অনিল কুমার বসাক। গত ২৫ মার্চ তাঁর শরীর খারাপ হয়। জ্বর অনুভব করেন। তখন থেকে তিনি অসুস্থ।

করোনা জয়ী চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক এবং তাঁর মেয়ে চিকিৎসক নিলীমা বসাক। ছবি: সংগৃহীত
করোনা জয়ী চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক এবং তাঁর মেয়ে চিকিৎসক নিলীমা বসাক। ছবি: সংগৃহীত

কীভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন, সে ব্যাপারে অনিল কুমার বসাক বলেন, 'আমি একজন অর্থোপেডিক সার্জন। নারায়ণগঞ্জের মেডিপ্লাস মেডিকেল সার্ভিসেস সেন্টারে প্রাক্টিস করি। হাত-পা ভেঙে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা করি। গত মার্চ মাসের শেষের দিকে দু-একজন জ্বরের রোগীও আমার কাছে এসেছিলেন। আবার আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একজন সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেন। আমি ধারনা করি, হাসপাতাল থেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হই। তখন আমার শরীরে জ্বর আসে। তাপমাত্রা হবে ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রি। আমার বাসার সবাইকে বলি দিই, কেউ যেন আমার কক্ষে না আসে। আমার রুমে কেউ আসত না।'
নারায়ণগঞ্জে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে আসেন অনিল কুমার বসাক। সেখানে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। বুকের এক্সরে করা হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে আমার শরীরের জ্বর বাড়তে থাকে। গত ২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে গিয়ে করোনার পরীক্ষা করার নমুনা দেওয়ার পর অনিল কুমার জানতে পারেন তাঁর করোনা পজিটিভ।
অনিল কুমার বলেন, সেদিনই আমি সরাসরি চলে আসলাম, উত্তরার কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে (সরকার নির্ধারিত করোনা রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র)। ভর্তির দিন হাসপাতালের সামনে ঘণ্টা দুয়েক হাসপাতালের সামনে বসিয়ে রাখা হয়। তারপর আমাকে ওই হাসপাতালের একটা ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। সেখানে আমাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। আমার মেজো মেয়ে নিলীমা বসাক সার্বক্ষণিক আমার সঙ্গেই ছিল। আমার শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। আমার শরীর এমন খারাপ হয় যে, আমার পাঁচদিন জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না। পরে আমাকে বেড থেকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হলো। এই হাসপাতালের আইসিইউয়ের ডাক্তারেরা খুবই কো-অপারেটিভ ছিলেন। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে আমার শরীর ভালো হতে থাকে। আমার কাশির মাত্রাটা কমে গেল।'
ভুক্তভোগী চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক বলেন, 'হাসপাতালের আইসিইউয়ের অনেক ডাক্তার আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কিছু ডাক্তার আছেন, যারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন, সবাই কিন্তু ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন না। আমি নিজে তো একজন ডাক্তার। এসব ডাক্তাররা যদি রোগীর কাছে বেশি করে যেতেন, অক্সিজেনটা ঠিকমতো সাপ্লাই দিতেন। তাহলে কিন্তু আরও ভালো হতো।'

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন করোনা জয়ী চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক ।ছবি: সংগৃহীত
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন করোনা জয়ী চিকিৎসক অনিল কুমার বসাক ।ছবি: সংগৃহীত

অনিল কুমার বসাক বলেন, 'আমি কয়েকজন ডাক্তার, নার্সকে বলেছি একটু আন্তরিক হন, তাহলে আরও অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। রোগীটাকে তো দেখতে হবে। যার অক্সিজেন দরকার, তাকে ঠিকমতো অক্সিজেন দিতে হবে। যার অবস্থা খারাপ তাকে আইসিউতে পাঠাতে হবে। যাদের যে পরীক্ষাগুলো করা দরকার, সেগুলো করতে হবে। ঠিক সময়ে রোগীকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। এসব সেবার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। অনেক সময় ওয়ার্ডের ডাক্তারদের ডেকে পাওয়া যায় না।'
সিনিয়র কনসাল্টেন্ট অনিল কুমার বসাক বলেন, 'করোনার ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর জ্বর আসে। কাশি হয়। শুকনো কাশি। আমার তো অনেক অসুখ। আমার ডায়াবেটিস আছে। গত বছর হার্টে আমার বাইপাস সার্জারি করা হয়। আমার উচ্চ রক্তচাপ আছে। এ জন্য আমার মৃত্যুঝুঁকি খুব বেশি ছিল। আমার অবস্থা কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার ভয় ছিল, করোনা থেকে আমার হার্টে কোনো সমস্যা হয় কি না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমি কিন্তু হাঁটতে পারতাম না, বসতে পারতাম না। আমার শরীরে কোনো শক্তিই ছিল না। এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে বহু ধরনের ওষুধ সরবরাহ করেছে।'
বয়স্করা ঝুঁকিতে জানিয়ে অনিল কুমার বসাক বলেন, 'এই হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বয়স্ক মানুষজনই বেশি মারা গেছেন। যাদের প্রেসার আছে, ডায়াবেটিস আছে, হার্টে সমস্যা আছে এবং লিভারে সমস্যা তারাই কিন্তু বেশি মারা যাচ্ছেন।'
এই চিকিৎসক বলেন, 'করোনা রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ভাব তিনি দেখেছেন। হাসপাতালে করোনা রোগীদের কাউন্সিলিং করা খুব জরুরি।'