যেভাবে এক মায়ের পাশে চার তরুণ

মায়ের কোলে আবিদ। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। সংগৃহীত
মায়ের কোলে আবিদ। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। সংগৃহীত

এখানেই শেষ নয়। হাসপাতালে নিঃসঙ্গ রুমা আক্তার নামের ওই মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন আরও তিন তরুণ-তরুণী। তাঁরা গত ১০ দিন কখনো ওই মায়ের কাছে গিয়েছেন ডায়াপার নিয়ে, কখনোবা স্যুপ-ওষুধ আর ফল নিয়ে। চিকিৎসক-নার্সদের প্রচেষ্টা তো ছিলই। সঙ্গে এই তরুণদের সহযোগিতায় যেন আবিদ নামের শিশুটি নতুন জীবন পেল। গতকাল শনিবার হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলেছে মা ও ছেলের। কয়েক দফা নমুনা পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাদের শরীরে আর করোনার অস্তিত্ব নেই।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ২১ এপ্রিল থেকে ওই শিশু চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। তার সঙ্গে ছিল কেবল মা। কারণ, বাবা ওমানপ্রবাসী। আবার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যাঁরা হাসপাতালে দেখতে আসতে পারতেন, তাঁরাও ঘরবন্দী। ওষুধপথ্য আর খাবার জোগাড় করা থেকে বাচ্চাকে দেখাশোনা—সবকিছুই একা সামলাতে হচ্ছিল রুমা আক্তারকে।

যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেদিনই চিকিৎসক শিশুটির জন্য একটি ইনজেকশন আনতে বলেন। কিন্তু হাসপাতালের আশপাশের ওষুধের দোকানে মেলেনি সেটি। হন্যে হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন আর কাঁদছিলেন অসহায় রুমা আক্তার। সেটি চোখে পড়ে ওই হাসপাতাল অন্য রোগে ভর্তি হওয়া এক নারীর। তিনি সবিস্তার জেনে বিষয়টি তুলে ধরেন ‘করোনা আপডেট চিটাগং’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে। এরপর ওই গ্রুপের অ্যাডমিন তানভীর রনি যোগাযোগ করেন কয়েকজনের সঙ্গে। দ্রুতই সাড়া মেলে ওসমান গণির কাছ থেকে।

পেশায় ব্যবসায়ী ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লালখান বাজার, ওয়াসা ও জিইসি মোড় এলাকায় একাধিক ওষুধের দোকানে খোঁজার পর না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়ে ফোন দিই ওই মাকে। শুনে তিনি কান্না শুরু করেন। সেই কান্নার আওয়াজ শুনে নিজেরও কান্না চলে আসে। পরে ছুটে যাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। অবশেষে সেখানে পাই।’

ইনজেকশনের সমস্যা মেটানোর পর তানভীর রনি ওই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আর কী কী লাগবে জেনে নেন। তারপর সেটি তুলে ধরেন গ্রুপে। এবার এগিয়ে আসেন রেবেকা হাসান নামের এক গৃহবধূ। তিনি ২৩ এপ্রিল সকালে স্যুপ, ওষুধ ও হরেক রকম ফল নিয়ে স্কুটি চালিয়ে ছুটে যান ওই নারীর কাছে। এরপর থেকে প্রতিদিন ফোনে ওই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে কখনো ইফতারি, কখনো বাচ্চার জন্য স্যুপ নিয়ে গেছেন হাসপাতালে।

রেবেকা হাসান বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত ওই শিশুর কথা শোনার পর নিজের দুটো বাচ্চার কথাই মনে পড়ছিল বারবার। পরিবারের অনেকেই বাদ সাধছিল। বলছিল কেন এত ঝুঁকি নিচ্ছি। তবে বোঝানোর পর তাঁরাও সাহস জুগিয়েছেন। এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে না দাঁড়ালে আর কবে দাঁড়াব?’

এই নারীর পাশে দাঁড়ানো আরেক তরুণী খতিজা বেগম। চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মরত এই নারী ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওষুধ পৌঁছে দেন ওই মায়ের কাছে।

‘২৪ এপ্রিল রাত ৮টা হবে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যেই জানতে পারি ওই শিশুর কিছু ওষুধ লাগবে। নিজের স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কয়েক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর পেয়ে যাই। সত্যি বলছি, ওই ওষুধটা সেদিন ওই মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েছে। অবশ্য এ ছিল আনন্দাশ্রু।’—খতিজা বেগমের গলায় যেন বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারার গর্ব।

গতকাল বিকেলে কথা হয় রুমা আক্তারের সঙ্গে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চন্দনাইশের পূর্ব জোয়ারার বাড়িতে ফেরার। তাঁদের ঘরে যাওয়ার গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন ওই তরুণেরা। সেসব জানাতে জানাতে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়া রুমা বলেন, ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিন নিজেকে খুবই বিপন্ন বোধ করছিলাম। এরপর এই তরুণদের কারণে আর কখনো মনে হয়নি আমি একা। তাঁরা আমার ভাইবোন। যত দিন বাঁচব, তাঁদের জন্য দোয়া করে যাব।’