করোনায় বিপাকে মানিকগঞ্জের মৎস্যখামারিরা

মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জ

করোনাভাইরাসের কারণে পরিবহনসংকটে মাছের খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে মাছের খাদ্যের দামও চড়া। এ ছাড়া মাছের দাম কম থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন মানিকগঞ্জের মৎস্যখামারিরা।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় মৎস্য আড়তগুলোও আগের মতো জমে উঠছে না। এ ছাড়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজনের হাতে টাকা নেই। তাই তাঁরাও মাছবাজারে কম ভিড়ছেন। আবার কোথাও কোথাও মাছের আড়ত বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারগুলোতে কম দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে। এসব কারণে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্যখামারিরা।


জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৮ হাজার ১০১ জন মৎস্যখামারি রয়েছেন। তবে সরকারি এই হিসাবের বাইরেও আরও অনেক খামারি আছেন। ব্যক্তিপর্যায়ে মাছের খামারগুলোতে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমি ব্যবহার করা হয়েছে। খামারগুলোতে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প, থাই পুঁটি ও তেলাপিয়ার চাষ করা হয়। এ ছাড়া কই, জিয়ল, শিংসহ বিভিন্ন দেশীয় মাছের চাষ করা হয়। বছরে জেলায় খামারিদের উদ্যোগে পুকুরগুলোতে ১০ হাজার ৫১৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়।


মৎস্য কার্যালয় ও খামারিদের সূত্রে জানা গেছে, খামারগুলোতে প্রতিবছরের মার্চে মাছের চাষ শুরু হয়। উৎপাদিত মাছ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি চলে। ফেব্রুয়ারিতে খামারগুলো আবার তৈরি করে মার্চে নতুন করে মাছ চাষ শুরু করা হয়। মানিকগঞ্জের খামারগুলোর মাছ স্থানীয় আড়তসহ ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়। গত এক মাসে করোনার কারণে আর্থিক লোকসানে পড়েছেন খামারিরা। অনেক খামারি স্থানীয় বাজারে কম দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। খামারে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মানিকগঞ্জের বাজারে প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছর এ সময়ে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় এসব মাছ বিক্রি হয়েছে।


ভুক্তভোগী কয়েকজন মৎস্যখামারি জানান, স্থানীয় খামারিরা ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জ থেকে রেণুপোনা সংগ্রহ করেন। করোনার এই পরিস্থিতিতে যানবাহনের সংকটের পাশাপাশি মাছের খাদ্যপ্রাপ্তিতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। এ ছাড়া মাছের খাদ্যেরও দাম বেড়েছে। প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) খইলের মূল্য ১ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ২০০ টাকা; প্রতি বস্তা ভুসি ১ হাজার ৪০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩৮০ টাকা এবং প্রতি বস্তা ধানের কুঁড়া ৮০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ১০০ টাকা হয়েছে। রেণুপোনার দামও বেড়েছে। এ ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনে বৃষ্টিপাতও কম হচ্ছে। ফলে পুকুরসহ অন্যান্য জলাশয়ে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অক্সিজেন-স্বল্পতার কারণে কোনো কোনো পুকুরে মাছও মারা যাচ্ছে।


পাঁচ বছর ধরে মাছের চাষ করেন ঘিওর উপজেলার হিজুলিয়া এলাকার খামারি বি এম শুভ। তিনি জানান, ১১টি পুকুরে ২০০ বিঘার বেশি জমিতে রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় ও দেশীয় মাছের চাষ করছেন। তবে পুকুরে পানি কমে অক্সিজেন-স্বল্পতার কারণে প্রতিদিনই মাছ মারা যাচ্ছে। মাছের আড়ত বন্ধ থাকায় ঢাকার অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী আসছেন না। তাই প্রায় অর্ধেক মূল্যে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি প্রায় তিন কোটি টাকা লোকসানের শঙ্কায় আছেন।


একই উপজেলার বরটিয়া এলাকার খামারি আশিকুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকার বেশি ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেছি। মাছ বিক্রি করে ডিসেম্বরে ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল। করোনায় অসহায় হয়ে পড়েছি। পুনরায় মাছ চাষ করতে খামার প্রস্তুত করতেও বিলম্ব হচ্ছে। কীভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করব, সেই চিন্তায় আছি।’


জেলা সদরের বড় খামারি রাশেদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত তিনি। এ বছরের মতো কখনোই এমন সংকটে পড়েননি।


জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, মাছের রেণুপোনা বা মাছ পরিবহনে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মাছের গাড়িসংকট বা হয়রানি বন্ধে সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়লে খামারিরা স্থানীয় মৎস্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।


মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, করোনায় খামারিদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় খামারিদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা মৎস্য বিভাগ মাঠে কাজ করছে।