কোভিড পরীক্ষায় 'কালাই মডেল'

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

জয়পুরহাট জেলার ছোট্ট উপজেলা কালাইয়ে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কোভিড-১৯-এর রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২৪ জন। উপজেলা স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, এতে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। শনাক্তকরণ বরং সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করেছে। তাঁদের ইউনিয়নভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ নমুনা সংগ্রহ অভিযান সুফল দিয়েছে।

২২ এপ্রিল থেকে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ১৫টি এবং পৌরসভায় ১টি অস্থায়ী বুথ বসিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। অভিযানটি লোকমুখে ‘কালাই মডেল’ নাম পেয়েছে। এ কাজে নেতৃত্ব দেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আশিক আহমদ। গুছিয়ে নমুনা সংগ্রহের বুদ্ধিটিও তাঁরই।

এভাবে ২ মে পর্যন্ত ১১ দিনে ৭০৩টি নমুনা সংগ্রহ করা গেছে। এগুলোর তিন-চতুর্থাংশের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এ–যাবৎ ২৪টি নমুনায় নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাব বলছে, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কোনো উপজেলাতেই এত কোভিড রোগী শনাক্ত হয়নি।

জয়পুরহাট জেলার হিসাবটাই ধরা যাক। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাবে ওই ১১ দিনে পুরো জেলার ৫ উপজেলা মিলিয়ে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩২ জন। দেখা যাচ্ছে, ৭৫ শতাংশ শনাক্তকরণই হয়েছে কালাইয়ে। পুরো জেলায় সংগৃহীত নমুনার ৪০ ভাগ এবং শনাক্তকরণ পরীক্ষারও প্রায় অর্ধেক কালাইয়ের। উপজেলাটির আদলে ক্রমে জেলার অন্যত্রও কাজ শুরু হয়েছে।

কালাইয়ের নমুনাগুলো যেসব জায়গায় পরীক্ষা করা হয়েছে, সেগুলোর একটি বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ। অধ্যক্ষ রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে বলে কালাইয়ে রোগী শনাক্তকরণও বেশি হচ্ছে। আর রোগী যত বেশি শনাক্ত হবে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণও তত সহজ হবে। কালাইয়ের ইউনিয়নভিত্তিক নমুনা সংগ্রহের কৌশলটি সবার জন্যই অনুসরণীয়।

কালাইয়ে কোভিড শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের ২২ জন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জফেরত। বাকি দুজন তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি। আরএমও আশিক বলেন, সংক্রমণ ছড়ানো শুরু হয় করোনা-অধ্যুষিত এলাকা থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তাই বেশি পরীক্ষা করে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অন্যদের থেকে আলাদা রাখাটাই (আইসোলেশন) কৌশলের মূল কথা।

গত ১৬ এপ্রিল জয়পুরহাটে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয়। কালাই উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ২১ এপ্রিল স্থানীয় সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদের সঙ্গে করোনাসংক্রান্ত এক বৈঠকে আরএমও আশিক আহমদ ইউনিয়ন পর্যায়ে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহের প্রস্তাব দেন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও পরীক্ষণাগারের কর্মীদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি দল গঠিত হয়।

এই দল ২২ এপ্রিল থেকে উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের প্রতিটিতে তিনটি করে এবং পৌরসভায় একটি ভ্রাম্যমাণ সংগ্রহ বুথ চালু করে। এসব বুথে বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ করোনা সংক্রমিত এলাকাগুলো থেকে যাওয়া এবং কোভিড-১৯-এর উপসর্গ থাকা ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন পালা করে পাঁচ ইউনিয়ন এবং এক দিন পৌরসভার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বুথ কাজ করে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সুরক্ষিত ছোট্ট বুথের বাইরে একটি চেয়ারে নমুনা দিতে যাওয়া ব্যক্তি বসছেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী ভেতর থেকে গ্লাভস পরা হাত বের করে তাঁর নাক ও গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন। দুজনের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় থাকছে। একেকটি নমুনা নিতে গড়ে আড়াই মিনিট সময় লাগছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, বুথে বুথে সংগৃহীত নমুনা দ্রুত তিন ভাগ করে ঢাকার আইইডিসিআর, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে।

প্রতিদিন ফলাফল আসছে। করোনাভাইরাস পজিটিভ ব্যক্তিরা যেন আলাদা হয়ে থাকেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা যেন ঘরবন্দী থাকেন, তা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের দলটিকে সহযোগিতা করছে স্থানীয় থানা ও প্রশাসন। দলের সদস্যরা গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন।

দলনেতা আশিক পুরো কর্মযজ্ঞে স্থানীয় সাংসদের সহযোগিতার কথা বিশেষভাবে বলেছেন। আর জয়পুরহাট-২ আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেছেন, সার্বিকভাবে জয়পুরহাট জেলায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বাড়ার নেপথ্যে আছে আশিক আহমদের পরামর্শ। কালাইয়ের মডেল অন্যত্রও অনুসরণ করা হচ্ছে।

কালাই উপজেলার পাশের জেলা বগুড়ার ১২টি উপজেলা মিলিয়ে ১ মে পর্যন্ত ৯৭০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২০ জন। জনসংখ্যার হিসাবে সেই জেলায় লাখে ২৭ জনের কোভিড পরীক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে কালাই উপজেলায় পরীক্ষা হয়েছে লাখপ্রতি ৪০০ জনের বেশি মানুষের।

জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কালাইয়ের মতো ছোট্ট একটি উপজেলা নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করানোতে যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তা বড় কোনো জেলাতেও হয়নি। সেখানে রোগী বেশি শনাক্ত হওয়াটা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উপজেলাটির সাফল্যের কথাই বলছে।