'করোনা করোনা কইরা বাবার লাশটাও ধরতে পারলাম না'

করোনায় আক্রান্ত বলে আজগর আলী হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে।
করোনায় আক্রান্ত বলে আজগর আলী হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে।

‘করোনা করোনা কইরা বাবার লাশটাও ধরতে পারলাম না। শুধু দূর থেইক্যাই দেখলাম। অথচ কবর দিয়া বাড়িতে আসার পরই রিপোর্টে জানলাম, বাবার করোনা নেগেটিভ। বাবার করোনা পজিটিভ হইছে বইলাই এক দিনের নোটিশে বাবাকে হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দেয়। আইসিইউতে থাকা রোগীর জন্য আইসিইউ সাপোর্ট আছে তেমন অ্যাম্বুলেন্সও ব্যবস্থা করে দেয় নাই। পরে আরেক হাসপাতালে নেওয়া, সেখানের ফরমালিটিস শেষ করতে করতেই বাবা মারা গেলেন। বাবার লাশ এলাকাতেও নিতে পারলাম না। এইটাতেই বেশি কষ্ট পাইতাছি।’

টেলিফোনে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের এনায়েত নগরের ব্যবসায়ী মো. বাদশা মিয়া। তিনি মো. হাজি জামালের বড় ছেলে। হাজি জামাল (৭০) গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। এর আগে তিনি ভর্তি ছিলেন গেন্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে। পরিবারের অভিযোগ, ভর্তির তিন দিন পর সেখান থেকেই করোনা পজিটিভ বলে ২৪ এপ্রিল রাতে হাজি জামালকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিতে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই রাতেই তিনি মারা যান।

টেলিফোনে বাদশা মিয়ার আক্ষেপ চলতেই থাকে। বলেন, ‘প্রথমে শুনলাম বাবা করোনা পজিটিভ, লাশ দাফনের পর শুনলান নেগেটিভ। আজগর আলী হাসপাতাল করোনা পজিটিভের একটা কাগজ দিয়া কুর্মিটোলা পাঠায় দেয়। মারা যাওয়ার পরে আজগর আলী হাসপাতালের লোকই টেলিফোন করে জানাইল, রোগীর রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। রোগী মারা গেছে, তা জানত না বইলাই মনে হয় ফোন দেয়।’

বাদশা মিয়া বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পরই আইসিইউতে রাখে, তখনো আমরা তাঁর কাছে যাইতে পারি নাই। জীবিত থাকতে আব্বারে দেখলাম না। মারা যাওয়ার পর রাজধানীর তালতলাতে দাফনের কথা বলে কুর্মিটোলা হাসপাতাল। নিজের এলাকায় কবর দেওয়ার জন্য অনেক বলে–কয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়া যাই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ এবং তাঁর দল দাফনের দায়িত্ব নেয়। পজিটিভ বইল্যা তারাও আমাদের কাছে যাইতে দেয় নাই, দূরে দূরে থাকি। পরিবারের সবাই পেরেশানিতে ছিলাম।’

মৃত্যুর পর জানা গেল হাজি জামাল (৭০) করোনায় আক্রান্ত নন।
মৃত্যুর পর জানা গেল হাজি জামাল (৭০) করোনায় আক্রান্ত নন।

বাদশা মিয়া জানালেন, তাঁরা তিন ভাই। এক ভাই মারা গেছেন। আরেক ভাই দেশের বাইরে থাকেন। এক বোন আছেন। মা বৃদ্ধ। তাঁদের বাবার কিডনির সমস্যা ছিল। ওই হাসপাতালেই কয়েক মাস আগে ডায়ালাইসিস হয়েছে, তখন বিল এসেছিল প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যায় তিনি হাসপাতালটিতে নিয়মিত চেকআপের জন্য যেতেন। করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না, স্ট্রোক করেন বলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ২০ এপ্রিল। হাসপাতালে রেখেই চিকিৎসা দিলে হয়তো ভালো হয়ে যেতেন। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৪ এপ্রিল সকালে ফোন দিয়ে ‘জলদি করেন’ বলে ওই রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে করে আরেক হাসপাতালে পাঠায়। এই টানাটানির ধকল তিনি নিতে পারেননি। আর কুর্মিটোলায় নেওয়ার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা সেই অর্থে চিকিৎসা শুরুই করতে পারেননি।

বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, যদি পজিটিভই হয়, তাইলে মারা যাওয়ার পর রিপোর্ট নেগেটিভ আসল কেমনে? আমার পরিবার যে হয়রানি আর পেরেশানির শিকার হইল, আমার বাবা মারা গেল, এর বিচার চাই।’

হাজি জামালের বিষয়ে জানতে দুই দিন চেষ্টা করেও আজগর আলী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রথম দিন ফোন করলে প্রতিবেদককে ফোনেই অপেক্ষা করতে বলে রিসেপশন থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে রিসেপশন থেকে জানানো হয়, প্রতিবেদকের মুঠোফোন নম্বর কর্তৃপক্ষ নিয়েছে, কর্তৃপক্ষই ফোন দিয়ে এ বিষয়ে কথা বলবে। তবে তারা আর ফোন করেনি। পরে আবার ফোন করলে রিসেপশন থেকে বলা হয় পরের দিন সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে ফোন করতে। পরের দিন ফোন করলে বলা হয়, টেলিফোনে কথা বলবে না কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদক সরাসরি গিয়ে কর্তৃপক্ষের কার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন জানতে চাইলে তা–ও বলা হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ টেলিফোনে বলেন, ‘কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে হাজি জামালের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা আছে কোভিড–১৯। তাই আমি ও আমার দল যথাযথ সুরক্ষা মেনে লাশ দাফন করি। তবে পরে পরিবার আমাকে জানায়, আমি যে লাশ দাফন করেছি, তা করোনা পজিটিভ ছিল না, নেগেটিভ ছিল। এটা আসলেই অমানবিক ঘটনা। করোনা পজিটিভ বলেই পরিবারের সদস্যরা লাশের কাছে যেতে পারেননি, বাড়িতে লাশ নিতে পারেননি। স্বাভাবিক রোগে মৃত্যু হলে যেসব ধর্মীয় আচার পালন করা হয়, তার কিছুই করতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। আর পজিটিভ শোনার পর এলাকায় পরিবারটির ওপর বাড়তি চাপ ও ভোগান্তি তো ছিলই। নারায়ণগঞ্জের এই কাউন্সিলর ৮ এপ্রিল থেকে কোভিড–১৯–এ মারা যাওয়া রোগী, করোনার উপসর্গ বা সন্দেহ করা হয়—এমন রোগীর লাশ এবং কিছু ক্ষেত্রে যক্ষ্মাসহ অন্যান্য রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশও দাফন ও সৎকার করছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলার করোনা বিষয়ে ফোকালপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক মো. জাহিদুল ইসলাম বললেন, ‘তিনি হাজি জামালের বিষয়টি শুনেছেন। করোনা পজিটিভ হিসেবে প্রথমে তালিকায় নাম তোলা হলেও পরে তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। করোনা পজিটিভ, না নেগেটিভ এ নিয়ে অনেককেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আর করোনা পজিটিভ শুনলে এলাকার অতি উৎসাহী জনতা এলাকা, বাড়ি লকডাউন করাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব নিজেরাই পালন করছে। আর পজিটিভ রিপোর্ট এলে বাড়তি সতর্কতা তো মেনে চলতেই হয়। তাই পরিবারগুলোর ভোগান্তি বাড়ে।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘আজগর আলী হাসপাতালের নিয়মিত ভর্তি আরেক রোগীকে করোনা পজিটিভ বলে হাসপাতালে রাখেনি। ওই রোগী পরে

নারায়ণগঞ্জে এসে চিকিৎসা নিয়ে এখন ভালো আছেন। তাই হাজি জামালের পরিবারের অভিযোগকে একেবারে নাকচ করে দিতে পারছি না।’

গত ৩০ এপ্রিল করোনা সন্দেহভাজন রোগীদের ভর্তির বিষয়ে সরকারি নির্দেশে বলা হয়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হিসেবে সন্দেহভাজন রোগীকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দেশের সব সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালের উদ্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ–সংক্রান্ত আদেশ জারি করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদেশে বলা হয়, সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে কোনো মুমূর্ষু রোগী কোভিড-১– এ আক্রান্ত বলে যদি সন্দেহ হয় এবং কোনো কারণে তাঁকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে ওই রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে ফোন করে রোগীর চিকিৎসা বা ভর্তিসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ওই রোগীর ভর্তি বা চিকিৎসার বিষয়ে করণীয় সমন্বয় করা হবে। এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে যোগাযোগের জন্য চারটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো ০১৩১৩৭৯১১৩০, ০১৩১৩৩৭৯১১৩৮, ০১৩১৩৭৯১১৩৯ ও ০১৩১৩৭৯১১৪০। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক হাসপাতালেই জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ থাকা অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। এতে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই নির্দেশ দিয়েছে।

পজিটিভ–নেগেটিভ নিয়ে আরও কয়েকটি ঘটনা:

গত ৩০ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনের প্রকাশিত খবর বলছে, রাজশাহীতে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে এক ব্যক্তি মারা যান। প্রথম দফা নমুনা পরীক্ষায় করোনা ‌‘পজিটিভ’ ছিলেন তিনি। সে হিসেবে জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তি তিনি। তবে দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষার জন্য মৃত্যুর আগের দিন তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। পরে সেই পরীক্ষার প্রতিবেদন ‘নেগেটিভ’ আসে।

৩ মে প্রথম আলোর আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পঞ্চগড়ে প্রথম শনাক্ত হওয়া নারীর পরের দুই পরীক্ষায় করোনা ‘নেগেটিভ’ এসেছে এবং তিনি সুস্থ আছেন।