করোনাকালে বৃদ্ধা মা ও তাঁর অসুস্থ ছেলের জীবন থেকে নেওয়া গল্প

বাড়ি ফিরেই সর্দি–জ্বরে আক্রান্ত ছেলে। প্রতিবেশীদের সহায়তা না পাওয়ায় বৃদ্ধা মা তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারছেন না। এরই মধ্যে একদিন অচেতন ছেলে। চারদিকে রটে গেল, করোনায় ‘মারা গেছেন’ তিনি। খবর পেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা এলেন, এল অ্যাম্বুলেন্সও, কিন্তু বাড়ি সড়ক থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায় না। এবারও সহায়তার জন্য আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি।

এবার এলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। খাটিয়ায় করে তাঁকে তুলে দেওয়া হলো অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতালে পৌঁছে শুরু হলো চিকিৎসা। ভর্তি করার দুদিন পর তাঁর চেতনা ফিরেছে। তবে শুরুতে যে সন্দেহ করা হয়েছিল, সেটাই সত্যি হয়েছে। পরীক্ষায় জানা গেছে, যুবকটি করোনায় আক্রান্ত।

গল্পের মতো শোনালেও এই ঘটনা জীবন থেকে নেওয়া। ঘটেছে শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দি ইউনিয়নের একটি গ্রামে। বর্তমানে ওই যুবক (৩০) শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় করোনা পরীক্ষার জন্য তাঁর মায়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই যুবক নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। গত ২৫ এপ্রিল গ্রামের বাড়িতে এসেই জ্বর, ঠান্ডা ও কাশিতে আক্রান্ত হন। বাড়িতে ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মা একা থাকায় তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। সহায়তার জন্য বিভিন্নজনের কাছে ছুটে গেছেন। কিন্তু করোনা সন্দেহে এগিয়ে আসেননি প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী। যুবকের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। বুধবার (২৯ এপ্রিল) রাতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।

বৃহস্পতিবার এলাকার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ওই গ্রামের এক যুবক মারা গেছেন। এমন খবর যায় ওই ইউনিয়নে কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারী সাদ্দাম হোসেনের কাছে। তিনি ছুটে যান ওই যুবকের বাড়িতে। পরিস্থিতি দেখে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস সোবাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্স আসে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি খাটিয়ায় তুলে আধা কিলোমিটার মেঠো পথ ওই যুবককে বহন করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন।

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় তাঁকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাৎক্ষণিক তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। দুই দিন পর শনিবার তাঁর চেতনা ফিরে আসে। শুক্রবার করোনার নমুনা সংগ্রহ করে শনিবার আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। সোমবার ফলাফলে জানা যায়, ওই যুবক করোনায় আক্রান্ত।

চিকন্দি ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারী সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে জানান, তিনি যখন ওই বাড়িতে যান, রোগী তখন অচেতন হয়ে পড়েছিল। তাঁর মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক কিছু তথ্য নিয়ে উপজেলায় যোগাযোগ করেন। তখন সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। ওই ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে সহায়তা করার জন্য স্থানীয় অনেককে অনুরোধ করেন, কিন্তু গ্রামের কেউ এগিয়ে আসেননি। তখন ইউনিয়নের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীদের সহায়তায় আধা কিলোমিটার পথ তাঁকে কাঁধে বহন করে অ্যাম্বুলেন্স তুলতে হয়েছে।

সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘একজন মানুষকে বাঁচাতে যখন কেউ এগিয়ে আসছিলেন না, তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। কষ্টে চোখের পানি ফেলেছি। তা–ও কাউকে পাইনি।’

অসুস্থ ছেলে বিছানায় ছটফট করছে, অচেতন হয়ে লাশের মতো পড়ে আছে। কারও সহায়তা না পেয়ে বৃদ্ধ মা সালেহা বেগম চোখের পানি ফেলে গেছেন। পাঁচটি দিন-রাত তিনি সেবা দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে, কিন্তু কারও সহায়তা পাননি।

সালেহা বেগম আজ মঙ্গলবার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৃত্যুর ভয়ে মানুষ এত অমানবিক হতে পারে, তা আমি ভাবতেও পারছি না। আমরা কেউ কি পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারব? তাহলে কেন এমন অমানবিক আচরণ করে মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা এগিয়ে না এলে আমার ছেলেটা মরে যেত, হয়তো সেই শোকে আমিও ঘরের মধ্যে মরে পড়ে থাকতাম।’

শরীয়তপুর সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস সোবাহান প্রথম আলোকে বলেন, ফোনে বিষয়টি জানার পর তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। কিন্তু রাস্তা থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে ওই ব্যক্তির বাড়ি। তখন আরেক সমস্যায় পড়ে যান স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্সের চালক। যখন তাঁদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন কোনো সহযোগিতা করছিলেন না, তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীদের অনুরোধ করলে তাঁরা এগিয়ে আসেন।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ওই যুবককে হাসপাতালে ভর্তি করার দুই দিন পর চেতনা ফিরে আসে। চিকিৎসা দেওয়ার পর তাঁর অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে। পরীক্ষা করার পর সোমবার জানা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। মঙ্গলবার তাঁর মায়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।