করোনাকালে চিকিৎসক-পুলিশের সুরক্ষায় তরুণদের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ

যশোরে ‌‌‘‌পাশে আছি আমরা’ সংগঠনের সদস্যদের তৈরি করা ফেসশিল্ড। ছবি: প্রথম আলো
যশোরে ‌‌‘‌পাশে আছি আমরা’ সংগঠনের সদস্যদের তৈরি করা ফেসশিল্ড। ছবি: প্রথম আলো

করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সামনের সারিতে যাঁরা কাজ করছেন, সেসব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ সদস্যের একধরনের সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে একটি সংগঠন। এটি দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে রাখা যায়। নাম ‘ফেসশিল্ড’। উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকেরা এটি ব্যবহার করেন। তাঁদের ব্যবহার করতে দেখে ফেসশিল্ড তৈরির উদ্যোগ নেন সংগঠনটির সদস্যরা। সংগঠনটি যশোরের। তাঁরা এটি তৈরি করে ইতিমধ্যে বিনা মূল্য বিতরণ শুরু করেছেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই ভয়াবহ পর্যায়ে এসে দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন যশোরের একদল তরুণ। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ফেসশিল্ড (হেলমেটের মতো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা একটি সরঞ্জাম) তৈরির কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। এই তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির নাম ‘পাশে আছি আমরা’। তাঁরা নিজেদের পকেটের টাকায় নিজেরা ফেসশিল্ড তৈরি করে সরবরাহ করছেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন সদস্য বলেন, গত এক সপ্তাহে তাঁরা ৪০০টির বেশি ফেসশিল্ড তৈরি করে যশোরের সিভিল সার্জন, যশোর জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ইবনে সিনা হাসপাতাল ও পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে চিকিৎসক ও পুলিশ সদস্যদের দিয়েছেন। আরও ৫০০টি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু টাকার অভাবে তাঁরা কাজটি এগিয়ে নিতে পারছেন না।

এই ফেসশিল্ড কতটা কার্যকর জানতে চাইলে যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই তরুণেরা যে ফেসশিল্ড তৈরি করেছেন, তা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। এগুলো মোটামুটি মানসম্মত। চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য তাঁরা আমাকে ১০০টি ফেসশিল্ড দিয়ে গেছেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালেও তাঁরা ১০০টির মতো দিয়েছেন। আমাদের যে পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে ফেসশিল্ড সরবরাহ করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে ওই তরুণদের উদ্যোগ খুবই আশাব্যঞ্জক।’

করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে ফেসশিল্ড ব্যবহার যে কতটা জরুরি, সে সম্পর্কে ওই সংগঠনের কয়েকজন সদস্য বলেন, ‘মুখে মাস্ক পরলেও চোখ ও কান ফাঁকা থেকে যায়। যে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে ঠিকঠাক সুরক্ষা হয় না। আবার মাস্কের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ফেসশিল্ড খুবই কার্যকর। কারণ, এটা কপালের ওপর থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত স্বচ্ছ শক্ত একটি অবরণে ঢাকা থাকে। ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে একেবারেই নিরাপদ থাকা যায়। অন্য দেশের পিপিই প্যাকেজের সঙ্গে ফেসশিল্ড থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য যে পিপিই দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ফেসশিল্ড থাকছে না। এ কারণে ওই তরুণের ফেসশিল্ড তৈরির উদ্যোগ নেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘পাশে আছি আমরা’ সংগঠনের সভাপতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী ফারদিন ইসলাম বলেন, ‘আমরা খেয়াল করলাম, উন্নত দেশের করোনা হাসপাতালে সেবাদানকারীরা যে পিপিই পরছেন, সেখানে ফেসশিল্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা পরা হচ্ছে না। যে কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। তখন আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া পিপিইর সঙ্গে ফেসশিল্ড দেওয়া হচ্ছে না। এ সময় আমরা গবেষণা করে ফেসশিল্ড তৈরি শুরু করলাম। গুণগত মান নিয়ে যশোরের সিভিল সার্জনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করা হয়েছে।’

ফেসশিল্ড কীভাবে তৈরি হয় জানতে চাইলে ওই সংগঠনের এক সদস্য বলেন, একটি ফেসশিল্ড তৈরি করতে ওএইচপি শিট (স্বচ্ছ), রেক্সিন টেপ, রাবার, ফোমসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম দরকার হয়। একটি তৈরি করতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ হয়।

যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীনের হাতে ফেসশিল্ড ভর্তি কার্টন তুলে দিচ্ছেন ‌‌‘‌পাশে আছি আমরা’ সংগঠনের কয়েকজন সদস্য। ছবি: প্রথম আলো
যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীনের হাতে ফেসশিল্ড ভর্তি কার্টন তুলে দিচ্ছেন ‌‌‘‌পাশে আছি আমরা’ সংগঠনের কয়েকজন সদস্য। ছবি: প্রথম আলো

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, পাশে আছি আমরা সংগঠনটির বয়স এক বছর। গত বছর স্থানীয় তরুণেরা যাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া করছেন, তাঁদের নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়নের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই সংগঠনটি মূলত প্রতিষ্ঠিত। কয়েকজন চাকরিজীবীও এ সংগঠনের সদস্য। সংগঠনের ১৫০ জন সদস্য রয়েছে। সদস্যদের অনুদানেই এর কার্যক্রম চালানো হয়। বসুন্দিয়া বাজারে এক ব্যক্তির ছেড়ে দেওয়া একটি ঘরে বসেই ওই তরুণেরা ফেসশিল্ড তৈরির কাজ করছেন। এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা এই চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংগঠনের অর্থ সম্পাদক খুলনা বিএল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তফা আল মোজাহিদ বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগের কথা শুনে বসুন্দিয়া বাজারের এক ব্যক্তি তাঁর একটি ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা সেখানেই সংগঠনের সাত থেকে আটজন মিলে এটি তৈরি করি। করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে (সামনে থেকে যাঁরা কাজ করছেন) সেই চিকিৎসক, পুলিশ ও সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে আমরা কাজটি শুরু করেছি। ইতিমধ্যে ৪০০টি তৈরি করতে গিয়ে আমাদের তহবিল শেষ। এখন আরও ৫০০টি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকার ঘাটতি রয়েছে। সরকারি কোনো অনুদান পেলে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আরও সহজ হবে।’