থমকে গেছে অনিল দাসের জীবনরথ

করোনা মহামারির মধ্যেও জীবিকার জন্য রিকশা নিয়ে বের হতে হয় দুই পা হারানো অনিলকে। ছবি: সেলিম জাহিদ
করোনা মহামারির মধ্যেও জীবিকার জন্য রিকশা নিয়ে বের হতে হয় দুই পা হারানো অনিলকে। ছবি: সেলিম জাহিদ

জীবনের চেয়ে জীবিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবন্ধী রিকশাচালক অনিল চন্দ্র দাসের কাছে। তাই করোনাভাইরাসের মহামারিও তাঁকে ঘরে বন্দী রাখতে পারেনি। এমন দুর্যোগের মধ্যেও জীবিকার অন্বেষায় রোজ রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয় দুই পা হারানো অনিলকে।

অনিল চন্দ্র দাসের সঙ্গে দেখা হয় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায়। লুঙ্গি পরা অনিলের মাথায় প্যাঁচানো গামছাই যেন তাঁর শক্তি। হাতে ভাইরাস প্রতিরোধী গ্লাভস নেই, গায়ে নেই সুরক্ষা পোশাকও; কেবল মুখে পাঁচ টাকা দামের একটি মাস্ক। জন চলাচল বন্ধের মধ্যেও বের হলেন? এমন প্রশ্ন করতেই অনিল চন্দ্রের কড়া চটজলদি জবাব, ‘কী করব বলেন, সংসার চালাইতে হয়। ঋণ-দেনা করে এত দিন খাইছি, কোনো সাহায্য পাইনি। এত দিন ঘরেই তো বইয়া ছিলাম, কেউ তো খাওন দেয়নি।’

দুই ছেলে, আর এক মেয়েকে নিয়েই অভাবী অনিল চন্দ্রের সংসার। থাকেন গুলশানের কড়াইল বস্তির জামাইবাজার এলাকায়। বস্তির মালিককে মাসে ঘর ভাড়া দিতে হয় চার হাজার টাকা। এর সঙ্গে আছে ছেলেমেয়ের পড়া, খাওয়াদাওয়া, নিজের ওষুধ-পথ্যসহ অন্যান্য খরচ। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার আঞ্জাম দিতে হয় তাঁকে। কিন্তু অনিল যে সুস্থ-স্বাভাবিক নন। তিনি যে নিজ পায়ে দাঁড়াবেন, সেই অমূল্য দুটি পা নেই তাঁর।

১৫ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারান ৫৫ বছর বয়সী অনিল চন্দ্র দাস। অক্ষেপ করেই বললেন, হারানো পা দুটিই তাঁকে নিঃস্ব করে রাস্তার ভিখারি করেছে। এই দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন স্ত্রী মায়ারানী। চাকরি করতেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার পদে। কিন্তু কী নির্মম নিয়তি, তিন বছর আগে রাজধানীর বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মায়ারানীও।

স্ত্রীর মৃত্যুর দিনের কথা স্মৃতিকাতর হয়েই অনিল হাত দিয়ে প্রতিবেদককে দেখিয়ে বললেন, ‘ঠিক ওই জায়গায় (বনানী চেয়ারম্যানবাড়ির পদচারী–সেতুর পূর্ব পাশ) আমার স্ত্রী লাশ পাওয়া যায়। ওই দিন ছিল ২০ রোজা, খুব সকালে, ৬টার দিকে। কিসে মেরেছে কেউ ধরতে পারেনি।’

অনিলের বাড়ি শেরপুর জেলা সদরের পূর্বশেরি গ্রামে। প্রায় ২০ বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাজধানীর এখানে-ওখানে বসবাস করছেন। স্ত্রী মায়ারানীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে অনিল কড়াইল বস্তিতে থাকেন। বড় ছেলে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছে, কিন্তু বেকার। মেজ ছেলে ক্লাস এইটে পড়ছে। আর একমাত্র মেয়ে এনজিওদের জাগো স্কুলে পড়ছে ক্লাস ফোরে। ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর অভাবী সংসার যেন আর চলছে না।

অনিল জানান, একসময় ভিক্ষা করতেন। কিন্তু ভিক্ষায় তাঁর ঘর ভাড়া, সংসার চলে না। আবার তাঁর শরীরটাও চলে না। কিছু একটা যে করবেন, সে অবস্থাও নেই। নেহাত রিকশা চালাতে গেলেও দুই প্যাডেলে পা চাপতে হয়। কিন্তু তাঁর সে পা দুটিও নেই। সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাটারি চালিত একটা অটোরিকশা কিনবেন। বছর তিনেক আগে অনেক কষ্টে ৫৭ হাজার টাকায় একটি রিকশা কেনেন। সে থেকে রিকশাই চালান। প্রতিদিন ব্যাটারিতে বিদ্যুতের রিচার্জ খরচ, আর মাসে দেড় হাজার টাকা গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে টেনেটুনে চলছিল অনিলের জীবন রথ। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যানবাহন ও জন চলাচল বন্ধের সরকারি নিষেধাজ্ঞা ঘরে বসিয়ে দেয় অনিলদের।

অনিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আগে সাত-আট শ টাকা থাকত। আট-নয় দিন ধরে বের হচ্ছি। দুই-চার শ যা পাই, তা দিয়ে চলি।’