বেকার ফাস্ট ইয়ারের সময় কাটে না

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com
অলংকরণ : প্রথম আলো
অলংকরণ : প্রথম আলো

পড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ স্টুডেন্টের বাবা এলেন। হাতে নীল রঙের খাম। দেখে কিছুটা চমকে উঠলাম। সঙ্গে এমন খাম নিয়ে এলে আগে খুশিই হতাম। কারণ, খামে করে টিউশনির সম্মানী নিয়ে আসতেন। কিন্তু এবার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটল। খানিকটা ভয়ও পেলাম। মাস পুরো হতে এখনো ঢের (১২ দিন) বাকি। মনের অন্তঃপুরে অজানা বিপদের আশঙ্কার আভাস পেলাম। মনে হলো টিউশনিটা বোধ হয় শেষ। আমাকে দিয়ে হয়তো আর তাঁদের সন্তানকে পড়াবেন না। হয়তোবা আমার পড়ানোয় তারা সন্তুষ্ট নয়। এমন নানা ভাবনা উঁকি দিতে লাগল।

অবশ্য, এমন ভয় পাওয়ার উপযুক্ত কারণও আছে। টিউশনিটা নতুন। আগে বহু টিউশনি কিছুদিন করার পর নানা কারণে ছাড়তে হয়েছে। আর টিউশনিটা আমার দরকারও ছিল। সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। মানে আমি এখন বেকার ফাস্ট ইয়ার। এ অবস্থায় ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে টিউশন ছাড়া টেকা দায়। আগে বিভিন্ন অজুহাতে বাসা থেকে টাকা নিলেও এখন তা প্রায় অসম্ভব। বাধ্য হয়েই টিউশন করতে হয়।

যা–ই হোক, আসল কথায় আসি, স্টুডেন্টের বাবা হাতের খামটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘স্যার, দেশের পরিস্থিতি ভালো না, আপনি বরং কিছুদিন ছুটি কাটান। করনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আইসেন।’ শুনে বেশ খুশিই হলাম। ভয় কেটে গেল। অতঃপর বাকি টিউশনিগুলো থেকেও চাওয়ামাত্রই ছুটি পেলাম। করোনাভাইরাস আসার আগে এমন ছুটি নিতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। এবার আর তা করতে হলো না।

ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়ি এলাম। চেনা গ্রামটাকে ভিষণ অচেনা লাগল। সবাই কেমন যেন পাল্টে গেছে। বাড়ির সদস্য ছাড়া সবাই যেন আমাকে দেখে বিরক্ত। কেউ কাছে আসে না। বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শী সবাই দূরত্ব বজায় রাখছে। অথচ আগে আসলে প্রতিবেশী সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় হতো। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হুইহুল্লোড়, আড্ডায় মেতে থাকতাম সব সময়। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যেতাম। কোন দিক দিয়ে ছুটি শেষ হতো, টেরই পেতাম না। কিন্তু এবার? একেবারে ভিন্ন চিত্র। বাধ্য হয়েই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষ করলাম। শুধু ১৪ দিন নয়, হোম কোয়ারেন্টিন মাস পেরিয়ে দেড় মাসের দিকে এগিয়ে চলেছে।

জীবনের চাকা যেন থেমে গেছে। বাড়িতে টিভি নেই। ঘরে নেটও পাই না। খেলার মাঠ, হাটবাজার, পাড়ার ছোট্ট চায়ের দোকান—সবখানেই আজ সুনসান নীরবতা। তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে যাব বলে তেমন বইটইও আনা হয়নি। মোবাইলে কিছু পিডিএফ বই ছিল, সেগুলোও পড়া শেষ। ঘরে থাকতে এখন দম বন্ধ হয়ে আসে। সময় যেন কাটতেই চায় না। একটি দিনকে হাজার মাসের মতো মনে হচ্ছে। কী দুঃসহ জীবন!

সারা বিশ্ব এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। গোটা বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্যে রয়েছে। যে সময়টাতে সারা বিশ্ব অতি ক্ষুদ্রকায় এক অণুজীবের কাছে পর্যুদস্তু, বিপর্যস্ত। পৃথিবীর মানচিত্র আজ দখলে নিয়েছে করোনাভাইরাস। এই তো কিছুদিন আগেও একেকজনকে দেখেছি ক্ষমতা, শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতে। তারা ভেবেই নিয়েছিল পুরো পৃথিবী তাদের নখদর্পণে। পৃথিবীটা যেন তাদের হাতের তালুতে থাকা ক্রীড়নক মাত্র। মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল পৃথিবীর চিত্র। আজ পুরো বিশ্ব কার্যত অচল ও স্থবির। সবাই ঘরবন্দী।

হু হু করে বাড়ছে লাশের মিছিল। পৃথিবীটাকে মৃত্যুপুরী বললেও অত্যুক্তি হবে না। আজ আর কোনো রাষ্ট্রনায়ককে বাকযুদ্ধ বা বাণিজ্যযুদ্ধের দামামা বাজাতে দেখছি না। সামরিক মহড়া, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ, মিসাইল ও ভারী অস্ত্রের প্রদর্শনীও হচ্ছে না। চুকে গেছে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধের’ মতো গালভরা শব্দ। কদিন আগেও মানুষ ব্যস্ত ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট তৈরি করতে। অথচ আজ তারা অতি অণুজীবকে প্রতিহত-পরাস্ত করতে পারছে না। নুয়ে পড়েছে তাদের দাম্ভিকতার শির; চূর্ণ হয়েছে অহমিকা। আজ ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা সবাই মৃত্যুভয়ে কাতর। প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক ক্ষমতার বলয়ে ঢেকে দিয়েছে পুরো পৃথিবী। পৃথিবীতে যেন প্রকৃতির ডাকা এক অঘোষিত কারফিউ চলছে।

করোনায় জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও বিশ্বজুড়ে এক পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতি আজ শান্ত, নীরব। পৃথিবী যেন নিজ হাতে নিজেকে সাজিয়ে–গুছিয়ে নিচ্ছে। কমেছে নাগরিক কোলাহল ও পরিবেশদূষণ। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণও কমেছে লক্ষণীয় মাত্রায়। ফলে বেড়েছে বন্য প্রাণীদের অবাধ বিচরণ। বন থেকে পশু-পাখিরা নেমে আসছে রাস্তায়। ডলফিন, তিমি, শুশুক ও জলজ প্রাণীরা ভিড়ছে সমুদ্রোপকূলে। প্রকৃতি যেন এমন সুনসান নীরব–নিথর দূষণমুক্ত পরিবেশই চায়। অতঃপর মানুষের মাঝে বেড়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। সুযোগ হয়েছে পরিবার–পরিজনদের সময় দেওয়ার। তৈরি হয়েছে মানুষকে সাহায্য–সহযোগিতার মানস। অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ ও সম্পদ দিয়ে অসহায়দের সহায় হচ্ছেন। বিশ্বও আজ এক মানবিক বিশ্ব দেখছে।

কিন্তু আফসোস! ‘চোরে না শোনে ধর্মের বাণী’। গোটা পৃথিবী থমকে দাঁড়ালেও আমার দেশের অনেক জনপ্রতিনিধি বিন্দুমাত্র টলেননি। অতি নিষ্ঠার (!) সঙ্গে তাঁরা ত্রাণের সম্পদ লুটে নিচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাল ও তেলচোরের দেখা মিলেছে। উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলায় সরকার একদিকে হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে নীতি–নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অনেকেই গরিব-অসহায়দের হক মেরে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। কারও ঘরের মেঝে খুঁড়ে চাল আবার কারও ঘরের খাটের নিচ থেকে শত শত তেলের বোতল পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে অবশ্য সাজাও পেয়েছেন। অসাধু ও স্বার্থান্বেষী এসব ব্যক্তির জন্য পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হচ্ছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারকে এগুলো কঠোর হাতে দমন করতে হবে। কারণ বিশৃঙ্খলাও মহামারির মতো ভয়ংকর।

পরিশেষে বলি, মহা পরাক্রমশালী বিধাতার কৃপায় এই মহামারি করোনার বিলুপ্তি ঘটুক। এই আধার অন্ধকার ভেদকর দূষণমুক্ত এক মানবিকতার সূর্য উদিত হোক। যেখানে থাকবে না কোনো মহামারি। থাকবে না এমন দূর্বিষহ স্বজনহীন মৃত্যুর ভয়। দেখা দেবে এক নতুন আলোকিত ভোরের।

*লেখক: চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]