দিনরাত কাটে শতবর্ষী বাবার চিন্তায়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমি সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকায় থাকি। আমার শতবর্ষী বাবা গ্রামে। বুঝতে পারছিলাম দীর্ঘ স্থবিরতায় যেতে হবে আমাদের। তাই লকডাউনের আগে আগে বাবাকে একবার দেখে এসেছি। সরকার সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের স্টেশন লিভ করতে বারণ করেছেন। মেনে চলছি।

আমার বাবাও সুস্থ আছেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় বাবা শতবর্ষ পার করে চলাফেরা, খাওয়া-পরা, ইবাদত-বন্দেগি সবই নিজেই করছেন। আমার মা নেই, কিন্তু বাবার এখনো আছে যৌথ পরিবার।

পরিবারের লোকজন যথেষ্ট সেবা, আদর-যত্নের মধ্যেই রাখেন বাবাকে। আছে চারদিকে নাতি-নাতনির কোলাহল, হইহুল্লোড়, ডাকাডাকি। তবু বাবা আমার প্রতিদিন খবর দেখেন আর আতঙ্কগ্রস্ত হন। আমরা ভাইবোনেরাও তা–ই। সারা বিশ্বই এখন আতঙ্কগ্রস্ত। কিন্তু আমাদের, মুসলমানদের আতঙ্ক অন্যদের থেকে ভিন্ন রকম। আমাদের আতঙ্ক শুধু মৃত্যুর নয়, মৃত্যুর চেয়েও বেশি আতঙ্ক, দাফন-কাফনের আতঙ্ক। সুস্থ মানুষ মারা গেলেও শেষ বিদায়টুকু সম্মানের সহিত, সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে বিদায় করতে না পারার আতঙ্ক। মৃত্যুতেও আপনজনকে কাছে না পাওয়ার আতঙ্ক, লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মোনাজাত করতে না পারার আতঙ্ক। 


টিভিতে খবর দেখতে না করারও উপায় নেই। কারণ, আমরাও দেখি। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় পার করাটা কষ্টসাধ্য। সকালে উঠে নামাজ, একটু হাঁটা-ব্যায়াম, চা-নাশতার পরে আর সময় কাটে না বাবার। ছুটিতে সবাই সবজি চাষ করছেন বাড়ির আঙিনায়। আমার ভাইও তার সময় কাজে লাগাচ্ছে বাড়িতে বিভিন্ন রকম গাছ লাগিয়ে, সবজি চাষ করে, এগুলোর সেবা-যত্ন করে। বাবা সেসবও তদারকি করেন, বারান্দায় বসে বসে দেখেন। কিন্তু কতক্ষণ, কত দিন! বয়স্ক মানুষের বাড়তি সতর্কতার জন্য গত ১৮ মার্চ থেকেই বাইরের কাউকে বাড়িতে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি বাড়িরই অন্য ঘরের কাউকেই বাবার কাছে যেতে দেওয়া হয় না। এটি আমার বাবার জন্য ভীষণ মনঃকষ্টের কারণ। কারণ, সারা দিনই যে মানুষটি বাড়ির সামনে বসে সবাইকে ডাকাডাকি করে, গল্প করে, সারা গ্রামের সবার খোঁজখবর নিয়ে দিন কাটাতেন, সেই মানুষ এখন গ্রিলঘেরা চার দেয়ালে বন্দী। টিভিই তখন ভরসা। বাবার ডায়াবেটিস আছে, শরীরে তিন-চারটি অপারেশনও আছে। এ ছাড়া এই বয়সে একটু ঠান্ডা-কাশি, যেকোনো সময় একটু গা গরম খুবই স্বাভাবিক। সময় মেপে মেপে বাবার গোসল-খাওয়া, সময় মেপে ওষুধ, চলাফেরা। একটু এদিক-সেদিক হলেই শরীরটা দুর্বল হয়ে যায়। জানি সবাই। তবু বাবা একটু কাশি দিলেই আমরা আদা-তুলসী-মধু মেশানো গরম পানি নিয়ে হাজির হই, এক্ষুনি ভালো করে ফেলার চেষ্টা সবার।

নিউইয়র্কে আমাদের দূরসম্পর্কের কম বয়সী একজন চাচা মারা গেছেন। স্ট্রোক করে বাড়ির পাশের একজন মারা গেছেন। ভয় পেয়ে যান আমার বাবা। করোনা মহামারি আমার বাবার দৃঢ় মনোজগতে খুব জোরে আঘাত করছে। খবর দেখার পর মাঝেমধ্যে বাবা চুপ হয়ে যান, আমাদের আত্মা তখন কেঁপে ওঠে। ভয় পাই আমরাও।

আমরা বাবার যে সন্তানেরা দূরে থাকি, তাদের দুশ্চিন্তাটাও একটু বেশি। বাবার কাছে থাকতে না পারার, প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে দৌড় দিয়ে পৌঁছাতে না পারার দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ মাথার ভেতরে। প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হওয়া সময়ের বাইরে কোনো ফোন এলেই আঁতকে উঠি, ভয় পাই, এই বুঝি কোনো খবর এল। বাবা শতবর্ষী হলেও এই ভয়, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তাগুলো এত দিন ছিল না। করোনার আতঙ্কে এ জিনিসগুলো মাথায় জায়গা করে নিয়েছে।

বাড়ির সব মানুষ, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী এবং দেশের সব মানুষের জন্যই মনটা ভারী হয়ে ওঠে, দোয়া করি সবার জন্য। এ ছাড়া যাঁরা এ সময়ে আমাদের ছেড়ে যাবেন, তাঁদের যেন সম্মানজনক বিদায় দিতে পারি। সেই শুভ অনুভূতি ও করোনা সচেতনতা মাথায় রেখেই সেই ব্যবস্থাপনার তওফিক যেন আল্লাহ আমাদের দেন। যদিও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এখন কাজ করছে, কিন্তু শহর-গ্রাম সবার জন্য সরকারিভাবে একটি পরিচ্ছন্ন নির্দেশনা প্রয়োজন। কেউ সাহায্য না করলেও যেন কষ্টের কারণ না হয়।

প্রথম আলোকে ধন্যবাদ এমন উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। প্রথম আলোর মাধ্যমেই সবার কাছে আমার শতবর্ষী বাবার জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ আমার বাবাকে শতবর্ষ আয়ু দিয়েছেন, এই করোনা মহামারি সময়টাতেও যেন রহম করেন, বাবাকে যেন সুস্থ রাখেন, সুরক্ষা দেন, হেফাজত করেন। আল্লাহ হেফাজত করুন আমাদের সবাইকে, সারা বিশ্বের সব মানুষকে।