'মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিছপা হব না'

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন পুলিশের এই চার সদস্য। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন পুলিশের এই চার সদস্য। ছবি: প্রথম আলো

করোনার সঙ্গে লড়ে জয়ী ঢাকা মহানগর পুলিশের চার সদস্য ফিরছেন নিজ নিজ দায়িত্বে। এ জন্য তাঁরা প্রস্তুত। মনোবলে অটল তাঁরা মৃত্যু এলেও পরোয়া নেই। এর আগ পর্যন্ত মানুষের সেবায় দায়িত্ব পালন করেই যাবেন। করোনার এই দুঃসময়ে এভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন অনেক পুলিশ সদস্য।

বৃহস্পতিবার ঢাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হাওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন—এমন চারজন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন।

ডিএমপির পরিবহন শাখায় কর্মরত পারভেজ মোশাররফ ভালোই ছিলেন। হঠাৎ গায়ে জ্বর। গলাব্যথাটা একেবারে সহ্যের বাইরে। পরীক্ষায় দেখা গেল, যা আশঙ্কা করছিলেন, তা-ই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এভাবে পুলিশ সদস্যরা কিন্তু কম সংক্রমিত হচ্ছেন না এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে। করোনায় যত মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, এর মধ্যে ১০ শতাংশ পুলিশ সদস্য। মারাও গেছেন ছয়জন। দেশে-বিদেশে সব জায়গায়ই শুধু খারাপ খবর।

এই যখন পরিস্থিতি, সাড়ে চার বছর আগে পুলিশে যোগ দেওয়া পারভেজ মানসিকভাবে একটু দুর্বলই হয়ে পড়লেন। তাঁরও যে করোনার সংক্রমণ। পারভেজ থাকেন ঢাকার রাজারবাগ ব্যারাকে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রী থাকেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে, মা–বাবার সঙ্গে। খবরটা শুনলে স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী যে হয়, ভেবে অস্থির তিনি। একপর্যায়ে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে পরিবারের সবাইকে পারভেজ জানিয়ে দিলেন নিজের অসুস্থতার কথা। স্ত্রী ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। ১৭ এপ্রিল রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হলেন পারভেজ। এক দিন পর ১৯ এপ্রিল স্ত্রী কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। করোনার সঙ্গে লড়ে পারভেজও জয়ী হলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে সবাই এখন ভালো আছেন।

পারভেজের সঙ্গে আরও ২০ সহকর্মীও সেরে উঠেছেন। সুস্থ হওয়ার পথে আরও অনেকে। তাঁদের একজন মো. মতিন। তিনিও পরিবহন শাখায় কাজ করেন। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকার বাসায় থাকেন। ৬ এপ্রিল কাজ সেরে বাসায় ফেরার পর জ্বর, গলাব্যথা। তিনি গরম পানিতে লবণ দিয়ে গড়গড়া করতে লাগলেন। কিছুতেই কিছু হয় না।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে পাঠালেন। এক দিন অপেক্ষা করলেন। ৮ এপ্রিল পরীক্ষা করাতে গেলেন, রিপোর্ট পজিটিভ। আরও দুদিন অপেক্ষা করার পর ১১ এপ্রিল রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন তিনি ছাড়া সেখানে আরেকজন ভর্তি। ১১ দিন পর দুটো রিপোর্টে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নেই নিশ্চিত হয়ে বাসায় ফিরেছেন।

নীলফামারির ছেলে আলমগীর হোসেন ১৫ এপ্রিল নমুনা দিয়েছিলেন। রিপোর্ট পজিটিভ পেয়ে ১৭ এপ্রিল হাসপাতালে যান, ফিরেছেন ৬ মে। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার খবরে ভয় পেয়েছিলেন কি না, জানতে চাইতে সংক্ষেপে জবাব দিলেন এই স্বল্পভাষী। তাঁর মধ্যেও রোগমুক্ত হয়ে ফিরে আসার আবেগটুকু ধরা পড়ল।

পুলিশ সদস্য মো. হাসান আলীকে অবশ্য গোড়া থেকে শক্তই থাকতে হয়েছে। ঢাকার কাছে ধামরাইয়ে মা–বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের যৌথ পরিবার। ওয়ারিতে দায়িত্ব পালন শেষে ক্লান্ত শরীরে ব্যারাকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙে বুকে চাপ আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে। করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হন।

রোগের খবর জেনে পরিবার ভীষণ মুষড়ে পড়ে। মো. হাসান আলী ফোন করে ঘরের লোকদের সাহস জোগাতেন, বলতেন তাঁর কিচ্ছু হয়নি। তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। সত্যিই তিনি সুস্থ হয়েছেন।

পুলিশে কেন এত সংক্রমণ
এই চারজন তো ঠিক হয়ে গেলেন, সংক্রমিত অনেকে এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুলিশের এত সদস্য সংক্রমিত হওয়ার কারণ কী?

এ ব্যাপারে মিডিয়া ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, মহামারিতে পুলিশের কাজের ব্যাপ্তি। সামাজিক দূরত্ব সবাই যেন বজায় রাখে, সে কাজ করছে পুলিশ, লকডাউন যেন ঠিকঠাক মানা হয়, সেটা নিশ্চিত করছে, ত্রাণ বিতরণ করছে, মৃতদেহের সৎকার করছে, তল্লাশিচৌকিতেও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সেদিক থেকে পুলিশ একেবারে সামনে থেকে ভাইরাসের মোকাবিলা করছে। তাই তাদের ঝুঁকিটাও বেশি।’

পুলিশের আবাসন-সংকটও একটা কারণ বলে মনে করেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মাঠে থাকা পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও সদস্য বলেছেন, বছর বছর পুলিশে সদস্যসংখ্যা বাড়লেও আবাসনের সুব্যবস্থার দিকে নজর ছিল না। মহামারির সময় পুলিশ প্রশাসন যতদূর সম্ভব নানা জায়গায় সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। কোথাও কোথাও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে অধীন সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, ট্রাফিক ব্যারাক চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসার পাশাপাশি রিকভারি সেন্টার করা হয়েছে রাজারবাগ স্কুল অ্যান্ড কলেজে। উপসর্গ থাকা পুলিশ সদস্যদের জন্য চারটি হোটেল, তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ডেমরা পুলিশ লাইনস ব্যবহার করা হচ্ছে। উপসর্গ না থাকা পুলিশ সদস্যদের কোয়ারেন্টিনের জন্য তিনটি হোটেল, উত্তরা পুলিশ লাইনস, রায়েরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ও ডিবি ব্যারাক ব্যবহার করা হচ্ছে এখন।

সবাই যেন একসঙ্গে সংক্রমিত না হন, এ জন্য এখন পুলিশ সদস্যরা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন।

লক্ষ্য এখন রোগমুক্ত থাকা, সংক্রমিত হলে পুলিশ সদস্যরা দ্রুত যাতে সেরে ওঠেন, সে উদ্যোগ নেওয়া। এমনটাই বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

কাজে ফিরতে প্রস্তুত
সেরে ওঠা চারজনই বলেছেন, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, সহকর্মীরা সাহস জুগিয়েছেন। এখন তাঁরা সুস্থ, কাজে ফিরতে প্রস্তুত।

পারভেজ মোশাররফের অবশ্য ছোট্ট একটা ছুটি চাই। মেয়েটাকে জন্মের পর ছুঁয়ে দেখেননি। একবার স্পর্শ করেই ঢাকায় কাজে ফিরবেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ কাজে ফেরত যাব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিছপা হব না। এটাই শপথ নিয়েছি। যত দুর্যোগ আসুক, মোকাবিলা করব।’