দুর্গম চরে ত্রাণ নিয়ে ছোটেন তিনি

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চর কলাগাছিয়ায় ত্রাণ বিতরণ করছেন ইউএনও মাশফাকুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চর কলাগাছিয়ায় ত্রাণ বিতরণ করছেন ইউএনও মাশফাকুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

তিন দিকে বিশাল সাগর। একদিকে খরস্রোতা নদী। মাঝখানে সবুজে ঘেরা একটি চর। এর নাম কলাগাছিয়া। ট্রলার ও নৌকা ছাড়া এই চর থেকে কোথাও যাতায়াতের উপায় নেই। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন এসব যান চলাচলও বন্ধ। এ কারণে খাদ্যসামগ্রী ফুরিয়ে যাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল চরের শতাধিক পরিবার। খবর পেয়ে তাদের জন্য এই দুর্গম চরে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হাজির হন ইউএনও। করোনা পরিস্থিতির কারণে নানা পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় ওই ইউএনও অন্যান্য চরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করছেন ত্রাণ।

কলাগাছিয়া নামের এই চর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায়। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসার পর ট্রলারগুলো এই চরে নোঙর করে। মাছ বাছাই ও বড় বড় চিংড়ির মাথা ফেলে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এখানে। আবার শুঁটকির মৌসুমে মাছ শুকানোর কাজ করা হয়। মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাত করা এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি তৈরির জন্য এখানে জেলেসহ শতাধিক পরিবার বাস করে।

কলাগাছিয়া চরের বাসিন্দা রেবেকা বেগম (৪০)। বেশ কয়েক বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁর। এরপর রেবেকা তাঁর ছেলে শাকিল (১৫) ও মেয়ে মুন্নিকে (১২) নিয়ে কাজের খোঁজে আসেন এই চরে। এখানে এসে কাজও পেয়ে যান। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোভাবেই দিন কাটছিল তাঁর। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি কোনো কাজ পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটছিল তাঁর। কিন্তু গত শনিবার ইউএনওর দেওয়া ত্রাণ পেয়ে তাঁর মুখে হাসি ফোটে।

কলাগাছিয়া চরের বাসিন্দা রেবেকার কাছে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কথা তাঁরা জানেন না। আগে এখানে ভাসমান দোকান বসত। সেখান থেকে চাল-ডাল কিনতেন তাঁরা। কিন্তু এখন আর কোনো দোকান বসে না। এখন সাগর থেকে মাছ নিয়ে ট্রলারও আসছে না। এই অবস্থায় কাজ না থাকায় ছেলে ও মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছিলেন না তিনি। এখন ইউএনও ত্রাণ দেওয়ায় তাঁর সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

কলাগাছিয়া চরের মানুষ যে দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, সেই খবর নানাভাবে ইউএনওর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। এসব অভাবী মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে তাই গত শনিবার ট্রলারে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে চলে আসেন দুর্গম এই চরে। তিনি চরের শতাধিক পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি চাল, ৩ কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি পেঁয়াজ, ১ লিটার সয়াবিন তেল, ১ কেজি লবণ ও ১টি করে তরমুজ বিতরণ করেন। এসব খাদ্যসামগ্রী পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান চরের মানুষ।

কীভাবে বিচ্ছিন্ন এই চরের মানুষের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গেলেন, তা জানতে চাইলে ইউএনও মাশফাকুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘কলাগাছিয়া বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা একটি ছোট চর। এটি উপজেলা সদর থেকে অন্তত ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে। যখন জানতে পারি, এই চরের মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তখনই সেখানে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী গত শনিবার সকাল আটটার দিকে ট্রলারে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে নিজেই ওই চরের উদ্দেশে রওনা দিই। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে পৌঁছাই। কিন্তু চরের মানুষ কিছু বুঝতে পারছিলেন না। যখন তাঁদের কাছে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়া শুরু করি, তখন অনেকেই আমাদের জড়িয়ে ধরে তাঁদের অভাব ও কষ্টের কথা বলতে থাকেন।’

ইউএনও বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কর্মহীন ও অভাবী মানুষের মধ্যে জনপ্রতিনিধিরা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছেন। তবে উপজেলার কলাগাছিয়া চরের মতো আরও কয়েকটি চরের মানুষের সমস্যার বিষয়টি হয়তো কারও নজরে আসেনি। এই কারণে আমি উপজেলার চর কলাগাছিয়া, চর কাসেম ও চর নজিরে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গিয়ে চরের মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি। চরের বাসিন্দারের ত্রাণ দেওয়ার এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’