কবে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাব

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

শিক্ষকতা আমার পেশা। শ্রেণিকক্ষ আমার কাছে অনেকটা পবিত্র ঘরের মতো। পড়ানোর সময় আমি অন্য এক জগতে ঢুকে যাই। এটাই আপাতত আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। এই ফাঁকে, নিজে একাগ্র চিত্তে পড়াশোনা করব বলে কিছুদিন ছুটি নিয়েছিলাম। সবকিছুই ঠিকঠাক আগাচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল করোনার বিস্তার। বিভিন্ন দেশের মৃত্যুর মিছিল আমার মনে বেশ দাগ কাটল। ভাবনার জগৎ জুড়ে করোনা আর করোনা; ব্যত্যয় ঘটল পড়াশোনার।

দিন যেতে না যেতেই এ দুষ্টু অতিথি এসে হাজির আমার দেশে। অনেক আগেই হয়তোবা এসে বসে আছে, খোঁজ রাখিনি। সবার মতো শঙ্কা আরও বেড়ে গেল। দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকার দিন শুরু হলো। দিন যত যায়, মনে চিন্তার রেখা ততটাই স্পষ্ট হয়। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি বাসায়। ভাইরাস চিন্তা জিলাপি প্যাঁচের মতো পেঁচিয়ে ধরে আমার এই ক্ষুদ্র চিন্তার জগৎকে।

সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে যেদিন প্রথম বের হই দেখি, পরিচিত রাস্তা একদমই সুনসান। দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ। সব মানুষই একি বেশ নিয়েছে। মুখের ওপর মাস্ক লাগানো। ম্রিয়মাণ ঠেকছে সব। একটু হেঁটে গিয়ে ফল কিনতে গিয়ে দেখি উদ্‌ভ্রান্ত কিছু মানুষ ভিক্ষার আশায় বসে আছে। এদের ঠিক আমার ভিক্ষুক মনে হলো না। কয়েকজন টাকা ও চালের জন্য আবদার করল। দেখে মনে হলো কত জনমের চেনা। একটু বয়স্কদের আমার মায়ের মতো দেখতে মনে হলো। ভিক্ষা চাওয়ার অভ্যাস নেই। তাই শূন্য দৃষ্টিতে গোটা দু–একজন তাকিয়ে রইল।

এভাবে কয়েক দিন কেনাকাটা করার জন্য বাইরে গিয়ে একই দৃশ্য দেখেছি। দেখেছি পুলিশকে খাবার বিলাতে। দেখেছি খোলা ফার্মেসি ও অন্যান্য কিছু দোকানে লেখা ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’। চারপাশেই একটা থমথমে ভাব। এ যেন এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সচেতন হওয়ার লড়াই।

এদিকে আমার ছুটি শেষ হয়ে আসে আসে। দিনে কত মারা যায়, কোথায় কী হচ্ছে—এ সবই যেন, না চাইলেও অদ্ভুতভাবে জেঁকে বসে মাথায়। ভেবেছিলাম ছুটি শেষে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাব। আবার পড়াব। সাহিত্য নিয়ে আলাপ হবে, প্রিয় শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হবে। হলো না। কী আর করা, অনলাইনেই পাঠদান করতে হবে।

কীভাবে চাকরিতে আবার যোগ দেব, কীভাবে অনলাইনে ক্লাস নেব, এ নিয়ে এক নতুন আশ্চর্যে ও ঘোরে দিন কাটে। মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার আকুতি কি অনলাইন দিতে পারে। কবে আবার সেই দিন আসবে। আমি আবার শ্রেণিকক্ষে যেতে পারব। ছাত্রছাত্রীরাও নিশ্চয় মুখিয়ে আছে কবে এ মিলন মেলা, প্রাণের মেলা আসবে। সেই ভোরের অপেক্ষায় আছি।

আর দেখছি মানুষ মানুষের জন্য কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ডাক্তাররা কী অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বিভিন্ন দেশের মানুষ নানাভাবে এসব হিতৈষী কাজকে নানা ঢঙে, নানারূপে উৎসাহ দিচ্ছে। সবাই সবার খোঁজ রাখার চেষ্টা করছে। এমনকি মানুষ তার পুরোনো ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইছে একে অপরের কাছে। মৃত্যুর চিন্তাও জেঁকে বসেছে কারও কারও মনে।

বাড়ির লিফটটিতে মানুষের ওঠানামা কম। তাই ওখানেই বিড়াল বাচ্চা প্রসব করেছে। আনন্দে খেলছে। আর আমার ভাইয়ের বাচ্চারাও এ নতুন অতিথিদের সঙ্গে বাতচিত চালাচ্ছে। আশা করছি, আমাদের সম্পর্কগুলোও এমন নিবিড় হবে। আমরাও মনের আনন্দে কাছে এসে, হাতে হাত মিলিয়ে প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরব। আবার আমরা কথায় মাতব। মাতব আড্ডায়। অনলাইনে না, খোলা আকাশের নিচে। অপেক্ষায় আছি, সে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসবেই।

*লেখক: সহকারী অধ্যাপক/ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। [email protected]