'ক্ষিধার সঙ্গে তো লজ্জা কইরা লাভ নাই'

প্রায় দুই মাস ঘরবন্দী থাকার পর নিরুপায় হয়ে আবার পথে বেরিয়েছেন সানাউল্লাহ। ছবি: লেখক
প্রায় দুই মাস ঘরবন্দী থাকার পর নিরুপায় হয়ে আবার পথে বেরিয়েছেন সানাউল্লাহ। ছবি: লেখক

‘পাঁপড় লাগব পাঁপড়...মচমচা পাঁপড়’—ডাকছে ফেরিওয়ালা। পাঁপড় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁর এই ডাক অন্য সময়ের মতো নয়। কেন এমন মনে হচ্ছে, তার তত্ত্বতালাশ করতে করতেই একই কণ্ঠ বলে উঠলেন—‘চাইল-ডাইল যা আছে কিছু দেন গো।’ শেষের এই ‘গো’ বলে ডাকটা বুকের ভেতরটা খালি করে দেয় একেবারে। এর আগের কথাগুলো হজম হতে চায় না। এবারে বোঝা যায়, কেন তাঁর প্রথম ডাকটিকেই অপরিচিত লাগছিল।

সাধারণত পাঁপড়, শনপাপড়ি, কটকটি, বাদাম-বুট ফেরি করে বেড়ানো লোকেদের দেখা গলি-ঘুপচির ভেতর সহজে মেলে না। তাঁরা থাকেন জনসমাগমস্থলে, যেখানে নিত্য মানুষের আনাগোনা হয়। আগে অবশ্য আসতেন হরহামেশাই। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, এ ধরনের ফেরিওয়ালার সংখ্যা তত কমছে। স্কুল, কলেজের গেট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা প্রায় হারিয়ে যাওয়া মেলা বা মেলার স্মৃতি হয়ে থাকা প্রাঙ্গণে তাঁদের দেখা মেলে। দেখা মেলে বৈকালিক উদ্যান ভ্রমণকালে।

এ ধরনের জাদুর ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালারা সহজে দেখা দেন না। গলি-ঘুপচিতে তাঁদের পা সহজে পড়ে না। যদিওবা ঢোকেন, তবে এমনভাবে নিজের ঝোলায় থাকা পসরার জানান দেবেন, যেন না দেওয়াটাই ইচ্ছা তাঁর। এই যে পাঁপড়ওয়ালা ডাকছেন, এমনি সময় হলে এত চিৎকার করে এত বড় বাক্য উচ্চারণ করে তিনি জানান দিতেন না। তাঁর স্বাভাবিক ডাকটি হতো হয়তো—‘এই পাঁপড়, পাঁপড়।’ তা–ও দু-একবার বলেই চুপ। কারণ, ততক্ষণে রাস্তায় থাকা শিশুর দল তাঁর চারপাশ ঘিরে ফেলত। আর বারান্দা বা জানলায় উঁকি দিত কত চোখ, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ এই সময়, এই ডাক কেমন বদলে দিল। শুরুতে যে ডাক অন্য রকম লাগল, তা তো এ কারণেই।

এদিকে লোকটি ডেকেই যাচ্ছেন, সঙ্গে সেই আহ্বান—‘চাইল-ডাইল যা পারেন কিছু দেন গো।’ বুকের ভেতর গিয়ে বিঁধছে। বুঝতে চাইলাম, এই চাল-ডাল তিনি পাঁপড়ের বিনিময়মূল্য হিসেবে চাইছেন কি না। ওপর থেকে বোঝা গেল না। দ্রুত নিচে নামতে হলো। দ্রুত এই কারণে য, ছোটবেলা থেকে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি, এই জাদুকরেরা দ্রুত মিলিয়ে যান। এক স্থানে তাঁদের হয়তো বেশিক্ষণ থাকতে মানা। সেই অভিজ্ঞতা দ্রুত নামার তাগাদা দেয়। ভুলেই গিয়েছিলাম যে এখন অন্য সময়। এই সময় আলাদা। নেমে দেখলাম, পাঁপড় নিয়ে এক মধ্যবয়সী লোক বসে আছেন রাস্তায়। তাঁর আশপাশে কেউ নেই। কোনো গলিতে এমন নিঃসঙ্গ পাঁপড়ওয়ালা দেখার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।

লোকটির নাম সানাউল্লাহ। বর্ণনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি পাঁপড় বিক্রেতা। ঝাঁকায় চূড়া করে রাখা পলিথিনে মোড়া মুড়মুড়ে পাঁপড় নিয়ে ঘুরে বেড়ান পথে পথে। পাড়া-মহল্লায় তেমন থাকেন না। ক্যাম্পাস বা উদ্যানেই যেতেন বেশি। কিন্তু এখন তো সব বন্ধ। তিনিও সব বন্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু আর পারছেন না। ‘তিন ছেলেমেয়ে, ওয়াইফসহ পাঁচজনের সংসার। আজ দুই মাস ঘর-বসা।’

কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বললেন, ‘সিপাহীবাগ চারতলা গলির পিছনে।’ তারপর সানাউল্লাহ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর নিজে থেকেই বললেন, ‘ক্ষিধার সঙ্গে তো লজ্জা কইরা লাভ নাই। আমগো মতো মানুষের জমা তো থাকে না। যা ছিল, কয়েক দিনেই শেষ। বাসা ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা বাকি পড়ছে। বাড়িঅলা কইছে ভাড়া দিতে, নাইলে বাসা ছাইড়া দিতে। দোকানেও বাকি পড়ছে চাইর হাজার টাকার বেশি। এহন আর বাকি দেয় না। হেও কী করব? মাল উঠাইতে হইব তো।’

এক টানে খুব সোজা বাংলায় সংকটকালের অর্থনীতিটি বুঝিয়ে দিলেন সানাউল্লাহ নামের এই জাদুকর। তিনি পাঁপড় বেচেন। আগে নিজেই বানাতেন। এখন কিনে এনে বিক্রি করেন। পাঁচ টাকা দরের প্রতি পাঁপড়ে দুই টাকার মতো লাভ থাকে। স্বাভাবিক সময়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে আনতেন। কিন্তু এখন তো নারায়ণগঞ্জসহ সব লকডাউন, তাই কাছেই মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে কিনে এনে বিক্রি করেন। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘মানুষ ভয় পায়। কিন্তু আমরা কী করমু? আমার শরীর খারাপ। আগে রিকশা চালাইছি একসময়। এখন আর ভারী কাজ করতে পারি না। তাই আবার পাঁপড় নিয়াই বাইর হইছি। ’ঝাঁকা দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন, সেই কখন বাইর হইছি, এখনো তেমন কিছু বিক্রি করতে পারলাম না।’

এই আলাপের মধ্যেই একজন এলেন মাস্ক পরে। দুটি পাঁপড় কিনলেন এবং বলে গেলেন, যাওয়ার সময় যেন সানাউল্লাহ মোড়ের দোকানে যান। জানালেন, সেখানে বলা আছে, গেলেই দুই কেজি চাল দেবে। এর বেশি তিনি পারছেন না। সানাউল্লাহ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

কেতা মেনে ‘ধন্যবাদ ’বললেন না। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে যা লেখা ছিল, তা তারও বেশি। তাঁর সঙ্গে কথা হতে হতেই আশপাশের বাসার অনেকে জানলা বা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পথ সুনসান বলে, কথা এখন সর্বগামী হয়ে উঠেছে। বোঝা গেল, অনেকেই আমাদের এই আলাপ শুনেছেন। দেয়ালের আড়ালে থাকা এই উৎসুক মানুষদের কেউ কেউ সাড়া দিলেন নানাভাবে। সানাউল্লাহ চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন শুধু। তাঁর চোখে কৃতজ্ঞতা ও উৎকণ্ঠা একসঙ্গে খেলে যাচ্ছে। মানুষের ঔদার্যে বেশিক্ষণ কৃতজ্ঞ থাকার বাস্তবতা থেকে তিনি তো কবেই বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের পর মনে মনে এই আশাটুকু ঘোরে শুধু—সুদিন আসুক সব জাদুকরের, সব মানুষের।