করোনা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ মতামত গুরুত্ব কম পাচ্ছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চিকিৎসক সুস্মিতা আইচ তাঁর অসুস্থ বাবা গৌতম আইচ সরকারকে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি কিছু হাসপাতালে ঘুরে কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। গৌতম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। তাঁর কিডনির সমস্যা ছিল। নিরুপায় পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে গত বৃহস্পতিবার তাঁকে ভর্তি করান করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। গত শনিবার তাঁর মৃত্যু হয়।

গত দুই মাসে এ রকম অভিযোগ আরও পাওয়া গেছে। চিকিৎসার জন্য গেলে কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী করোনায় আক্রান্ত কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সনদ দেখতে চাইছে। করোনা পরীক্ষাও সহজে করানো যাচ্ছে না, সনদ পাওয়াও কঠিন। আবার ভর্তি রোগী করোনায় আক্রান্ত জানার পর হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, এমন অভিযোগও আছে। এ রকম কিছু সমস্যা সমাধানের পথ বলে দিয়েছে সরকার গঠিত ১৭ সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তবে কমিটির সুপারিশ গুরুত্ব কম পাচ্ছে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, আমাদের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে সরকার।’ তবে কমিটির একাধিক সদস্য এ ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সদস্য বলেছেন, ‘আমাদের কথা না শুনুক, ক্ষতি নেই। দরকার হলে সরকার কমিটি ভেঙে দিক। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমুক।’

১৮ এপ্রিল এই কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা কমিটির সদস্যসচিব। ১৭ সদস্যের কমিটিতে অন্যদের মধ্যে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক তিন উপাচার্য মাহমুদ হাসান, মো. নজরুল ইসলাম ও প্রাণ গোপাল দত্ত, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদ খান, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শাহলা খাতুন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ইকবাল আর্সলান, আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান, অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি রওশন আরা বেগম, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সিনিয়র পরিচালক শামস এল আরেফিন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোহিত কামাল, সিনিয়র অবেদনবিদ খলিলুর রহমান, সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ তারিকুল ইসলাম, জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক প্রধান মো. গোলাম মোস্তফা এবং বিএসএমএমইউয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন সাত্তার।

>

চিকিৎসা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, ল্যাবরেটরি, মানসিক স্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিষয়ে পৃথক প্রতিবেদন ও সুপারিশ।

এই কমিটি দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পাঁচটি উপকমিটি তৈরি করেছে। উপকমিটিগুলো কোভিড-১৯ রোগী চিকিৎসা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক, মানসিক স্বাস্থ্য এবং রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিষয়ে পৃথক প্রতিবেদন ও সুপারিশ তৈরি করে। এরপর কমিটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এর কপি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছেও দেওয়া হয়। তবে সেই প্রতিবেদন বা সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব (সেবা বিভাগ) মো. আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কারিগরি কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ হচ্ছে। কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে, কিছু করার চেষ্টা চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এসব বিষয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে।

সুনির্দিষ্ট পথ

গৌতম আইচ সরকারের ঘটনার উল্লেখ করে জাতীয় কারিগরি কমিটির একজন সদস্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, হাসপাতালে ভর্তির সমস্যা কীভাবে দূর করা সম্ভব, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা কমিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছে।

কমিটি বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। কোন হাসপাতালে কত শয্যা, কখন কত শয্যা ফাঁকা, কতজন চিকিৎসক, নার্স দায়িত্ব পালন করছেন—এসব তথ্য নজরে আনার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ড্যাশবোর্ডে এটা দেখা সম্ভব। এ রকম ড্যাশবোর্ড স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যবহার করে। রোগী কোনো হাসপাতালে গেলে তাঁকে ফিরিয়ে না দিয়ে দেখতে হবে কোন হাসপাতালে তাঁকে পাঠানো যায়। তাকে হয় চিকিৎসা দিতে হবে, না হয় অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।

কোভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিকিৎসার মান উন্নত করার ব্যাপারেও কমিটি সুপারিশ করেছে। বলেছে, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে কাজে পাঠাতে হবে। কাজে বিরতি, ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার প্রায় সব কাজ বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব ব্যাপারে জানার জন্য গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে স্বাস্থ্যসচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেছেন, রোগী যাতে ফেরত না যায়, বিষয়টি নিশ্চিত করতে চারটি ফোন নম্বর ঠিক করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালের ওই নম্বরগুলো ব্যবহার করার কথা।

রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা বিষয়ে কারিগরি কমিটি বলেছে, দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, নমুনা দিতে চাচ্ছেন অথচ দিতে পারছেন না, এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ক্রমপুঞ্জীভূত সংখ্যা অনেক বড় হচ্ছে। এটা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুতরাং নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বাড়ানোর কথা কমিটি বলেছে। কিট সংগ্রহ ও বিতরণ, নমুনা সংগ্রহ, ল্যাবরেটরির সক্ষমতা বৃদ্ধির কথাও তারা বলেছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে। প্রথম দিকে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ওপর একক নিয়ন্ত্রণ ছিল আইইডিসিআরের। যোগ্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে তারা নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেয়নি। সময় থাকতে ল্যাবরেটরি ও জনবল প্রস্তুত করা হয়নি। মে মাসে এসে জানা যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠানেরই রোগ শনাক্ত করার মতো যন্ত্র আছে। কিন্তু জনবল ও অন্যান্য ছোটখাটো সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ৩৬টি ল্যাবরেটরিতে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা চলছে। এসব ল্যাবরেটরিতে সবশেষ এক দিনে ৫ হাজার ৭৩৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। অর্থাৎ একটি ল্যাবরেটরি ১৬০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করছে। জনসংখ্যার অনুপাতে এটি অনেক কম।

নমুনা পরীক্ষা ও ল্যাবরেটরিগুলো সমন্বয় করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে নির্দিষ্ট হাসপাতালের পাশাপাশি ১০টি বুথে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী এক দিনে আরও ১০টি বুথ বাড়বে। অন্যদিকে ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতাও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে।

জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলেছিল, সংক্রমণের প্রবণতা কমতে থাকলে, লকডাউন (অবরুদ্ধ) শিথিল করার প্রক্রিয়া শুরু করলে ফল ভালো পাওয়া যাবে। লকডাউন শিথিল করা কারিগরি বিষয় হলেও সরকার এ ব্যাপারে কমিটির মত নেয়নি বলে জানা গেছে।

লকডাউনসহ বিভিন্ন বিষয় ৫ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় তুলে ধরেন কমিটির প্রধানসহ অন্যান্য সদস্য। সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসচিব মো. আসাদুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ২০ এপ্রিল কারিগরি কমিটি সভা করে সরকারকে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কারিগরি কমিটি নতুন কিছু বলেনি।

সূত্র বলেছে, বিভিন্ন কমিটি যেসব সুপারিশ করছে, তার বাস্তবায়ন তদারকির জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি সেল করার কথা হয়েছিল ৫ মের সভায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব আসাদুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক বিষয়গুলো নজরদারি ও তদারকির জন্য একটি সেল খোলার প্রক্রিয়া চলছে। হয়তো কমিটিরই একজনকে এর নেতৃত্বে রাখা হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি সুপারিশই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের। তারা বাস্তবায়ন না করলে এর মূল্য দেবে দেশের মানুষ। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, সমন্বয়হীনতা ও কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা না থাকার কারণে বিষয়গুলো এভাবে আলোচনায় আসছে।’