ভয়কে জয় করা ৫ তরুণীর কথা

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে কাজ করছেন দুই তরুণী।  ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে কাজ করছেন দুই তরুণী। ছবি: সংগৃহীত

‘করোনাভাইরাসের কারণে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। লকডাউনে বেড়েছে অস্থিরতা। ভয় আর আতঙ্কে দিন পার করছেন রোগীরা। এ সময় মানুষের জন্য যদি কিছু করতে না পারি, তাহলে জীবনে সার্থকতা আসবে না। তাই আগপিছ না ভেবে মানুষের সেবায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছি।’

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী জমিলা বেগম। দীর্ঘ ১০ বছর জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শেষে কিছুদিন আগে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে এসেই আটকে যান লকডাউনে। তবে জমিলা ঘরে বসে না থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে করোনা শনাক্ত ও গবেষণার কাজ শুরু করেন ভেটেরিনারির ল্যাবে।

শুধু জমিলাই নন, এই ল্যাবে কাজ করছেন আরও চার নারী—আফিফা হালিম, সৈয়দা শামিমা নাসরিন, জাহান আরা ও সাবিহা জেরিন। তাঁদের মধ্যে শামিমা ও আফিফাও বায়োটেকনোলজি বিষয়ে দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এ পাঁচ নারী স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও ল্যাবে কাজ করছেন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সিরাজুল ইসলাম ও শিক্ষক ইফতেখার আহমেদ।

>চট্টগ্রাম ভেটেরিনারির ল্যাবে কাজ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করা চট্টগ্রামের পাঁচ তরুণী

এই স্বেচ্ছাসেবকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ। এ আপৎকালে তাঁদের বসবাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালার ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। পাশাপাশি তাঁদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জোগানও রাখা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেছে সানশাইন চ্যারিটিজ নামে একটি সংগঠন। আর সুরক্ষা উপকরণ ফেস শিল্ড দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা দৃষ্টি। আর ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) দিয়ে সহায়তা করেছে চট্টগ্রাম কলেজ ২০০১ ব্যাচ।

ফেসবুক ও শিক্ষকদের মাধ্যমে জেনে এ ল্যাবে কাজ করতে আসেন এসব শিক্ষার্থী। আফিফা হালিম ভারতের পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে নিজ জেলা চট্টগ্রামে আসেন বেড়াতে। অন্যদের সঙ্গে করোনা রোগী শনাক্তের জন্য নমুনা পরীক্ষার কাজ করছেন তিনি। আফিফা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ছেড়ে আগরতলা গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে। প্রথমে নিজেকে মনে হচ্ছিল তেমনি একজন। প্রথম যেদিন বাসা থেকে তল্পিতল্পাসহ এখানে থাকতে চলে এলাম, মনে হলো দেশকে বাঁচানোর অজানা যুদ্ধে চললাম।’

সৈয়দা শামিমা নাসরিন পড়াশোনা করেছেন জার্মানির গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে। চট্টগ্রামে কোভিড-১৯–এর কার্যক্রম দেখে ল্যাবে কাজ করতে আগ্রহী হন তিনি। ই–মেইলে যোগাযোগ করেন উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশের সঙ্গে। ইতিবাচক সাড়াও পেয়ে যান তিনি।

নাসরিনের মতে, বিদেশ থেকে তিনি যে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তা দেশের মঙ্গলে কাজে লাগাতে পারার মতো আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তাই এই করোনাকালে তিনি নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে মানুষের সেবা করতে চান।

এই স্বেচ্ছাসেবীরা বলেন, যেকোনো ভাইরাস নিয়ে কাজ করা ঝুঁকির। কোভিড-১৯ দ্রুত ছড়ায় বলে এতে ঝুঁকি আরও বেশি। ল্যাবে প্রতিদিন সংগ্রহ করা নমুনা প্রক্রিয়াজাতকরণ, আরএনএ পৃথক করাসহ একাধিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক না থাকলে বিপদ হতে পারে।

দুই তরুণী বলেন, প্রথম দিকে নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষজন কাজটিকে ভালোভাবে নেননি। কাজ শুরুর সময়ও নানা বিপত্তিতে পড়তে হয়। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে এখন তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।

ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এ ল্যাবের প্রধান পরিচালক অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকী বলেন, ‘ইচ্ছাশক্তির জোরেই মেয়েরা তাঁদের পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন—এ কাজ দেশের জন্য, মানুষকে বাঁচানোর জন্য। আমি তাঁদের কাজকে সাধুবাদ জানাই।’