ইতিহাসের রাজপথ থেকে বিদায়

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ১২ ডিসেম্বর ২০১৯। গুলশানে তাঁর বাসভবনে।  দীপু মালাকার
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ১২ ডিসেম্বর ২০১৯। গুলশানে তাঁর বাসভবনে। দীপু মালাকার

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। আনিসুজ্জামানের এই চিরপ্রস্থানে তাঁর পরিবারের সদস্যরা হারালেন নিকটতম মানুষটিকে, ছাত্ররা হারালেন মনস্বী শিক্ষককে, বন্ধু ও অনুরাগীরা হারালেন নম্রভাষী সুরসিক স্বজনকে; কিন্তু জাতি হারাল অনন্য এক অভিভাবক। তরুণ বয়স থেকে মুখর এক কর্মময় জীবন তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন। আর সে জীবন মিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উত্থান–পতনময় বন্ধুর পথে।

আনিসুজ্জামানের পেশাজীবন কেটেছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়। কিন্তু তাঁর অনুরাগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে সীমিত ছিলেন না। দেশের সীমানার ভেতরে ও বাইরে নানা মহলে ছড়িয়ে আছেন তাঁরা। আনিসুজ্জামানের উদারতা, রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা বিচিত্র মত ও পথের মানুষকে তাঁর বন্ধু ও শুভার্থী করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে অজাতশত্রু।

আনিসুজ্জামানের তারুণ্যের উন্মেষ পূর্ব বাংলার মানুষের নবতর আত্মপরিচয় ঘোষণার ঐতিহাসিক সূচনালগ্নে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে। এরপর তাঁর জীবন মিলেমিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে। তাঁর সৃষ্টিশীল ভাবনা আর উদ্যম বাঙালির সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল বিচিত্র ধারায়।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। ছাত্র ছিলেন বাংলার, কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতির বিচিত্র ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর অন্তর্দৃষ্টিময় গবেষণা। ক্লাসের ক্ষুদ্র পরিসীমা ছাপিয়ে তাঁর অভিষেক ঘটেছিল বৃহত্তর সমাজের শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষক, গবেষক, কর্মী—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান সমীহ জাগানো। আনিসুজ্জামানের মধ্যে সব এক সহজ স্রোতোধারায় এসে মিশেছিল। শিক্ষক ও গবেষকসত্তা অনায়াসে একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কর্মিসত্তার সঙ্গে। বিবেকিতায় ও সংকটকালে হয়ে উঠেছিলেন জাতির নির্ভরতার জায়গা।

>আনিসুজ্জামান ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, বাঙালির ইতিহাসের সামনের কাতারের অংশগ্রহণকারী >তাঁর বিদায়ে অস্ত গেল একটি যুগের মহিমা

দেশভাগের পর থেকে যেসব রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে এই ভূখণ্ডের মানুষ মুক্তি খুঁজেছিল, সেগুলোতে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন প্রাণের টানে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন যুক্ত হন, তখনো তিনি স্কুলছাত্র। ১৯৬০–এর দশকে পাকিস্তান সরকারের প্রচণ্ড রবীন্দ্রবিরোধিতার কালে রবীন্দ্রশতবর্ষ পালনে রেখেছিলেন সক্রিয় ভূমিকা। অমিত সাহসিকতার সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এক সংকলনগ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের আগের দশকজুড়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি যখন নতুন আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে উন্মুখ, সে সময়ে সামনের সারিতে থেকে তিনি অংশ নিয়েছেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও সাহিত্যিক উদ্যোগে।

আনিসুজ্জামান যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। সে সময়ে কলকাতায় গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা ছিল বাঙালি চেতনার জাগরণ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে। একাত্তরের পরে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা ও অসাম্প্রদায়িকতার উদ্বোধন।

স্বাধীনতার পর আনিসুজ্জামান মাতৃভাষা বাংলায় নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনায় যুক্ত হয়েছিলেন। দেশে যখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তখনই শোনা গেছে তাঁর দৃঢ় কণ্ঠ। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সময়ে নাগরিক–সমাজের হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে ছিলেন অগ্রণী। গণ–আদালতে অভিযোগ এনেছেন একাত্তরের গণহত্যার পুরোধা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

আনিসুজ্জামান ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের, কিন্তু বারবার ছাপিয়ে গেছেন বিষয়ের সীমানা। সাহিত্যকে মিলিয়ে দেখেছেন এ অঞ্চলের নর–নারীর আত্মবিকাশের প্রচেষ্টার সঙ্গে। সাহিত্য–গবেষণায় যোগ ঘটিয়েছেন জ্ঞানের আরও নানা শাখার। নতুন তথ্যে, ভাষ্যে ও বিশ্লেষণে ভেঙে দিয়েছেন পুরোনো ধারণা।

গবেষণায় তাঁর মৌলিক অবদান প্রচুর। তাঁর পিএইচডি গবেষণায় তিনি তুলে ধরেছিলেন বাঙালি মুসলমানের মানসিকতার বিবর্তনের রেখা। পরে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য নামে সেটি বই হয়ে বেরোয়। কথিত মধ্যযুগেও যে বাঙালি সমাজে ছিল নারীর নিজস্ব অবস্থান, তা নিয়ে লিখেছেন বাঙালি নারী বইটি। ইংরেজ উপনিবেশের ঔরসে বাংলা গদ্যের জন্ম—এই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব খারিজ করেছেন গভীর অনুসন্ধানী গবেষণায় পুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ে। নমুনা হাজির করে প্রমাণ করেছেন যে চিন্তা ও ভাবের বাহন হিসেবে বাংলা গদ্যের উন্মেষ ইংরেজ আসারও বহু আগে।

শুধু গবেষণার বিদ্যাচর্চার পরিসরেই আনিসুজ্জামানের রচনাধারা আটকে থাকেনি। বিচিত্র শৈলীর রচনা লিখেছেন তিনি। লিখেছেন ভাষা নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে, উদার গণতন্ত্রের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবী—এই তিনটি বইয়ে যে আত্মস্মৃতি আনিসুজ্জামান লিখেছেন, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস বোঝার জন্য তা অভূতপূর্ব দলিল হয়ে রইল। তাঁর বিপুলা পৃথিবী স্মৃতিকথাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোতে। তাঁর লেখার পাঠক ছিলেন মূলতই বড়রা, কিন্তু ছোটরাও তাঁর মনোযোগের বাইরে সরে যায়নি। ছোটদের জন্যও আছে তাঁর একাধিক বই।

আনিসুজ্জামান যে শূন্যতা রেখে গেলেন, তা যেন একজনমাত্র ব্যক্তির নয়। তাঁর জীবন, কর্ম ও গবেষণার কাছে বাঙালি নিজের আত্ম–অনুসন্ধানের জন্য ফিরে ফিরে আসবে।