বাংলাদেশের চেয়ে পরীক্ষা কম শুধু আফগানিস্তানে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮৭৮ জনের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এর চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে শুধু আফগানিস্তানে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অনেক কম।

বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ৪১টি ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২০টি এবং ঢাকার বাইরে ২১টি ল্যাবরেটরি রয়েছে। এসব ল্যাবরেটরিতে দিনে ১২ হাজারের ওপর নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা থাকলেও এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছে ৭ হাজার ৯০০টি। ফলে বিদ্যমান ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গত বুধবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৯২৩ জনের করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে। এক মাস আগে পরীক্ষা হচ্ছিল প্রতি ১০ লাখে ৮০ জনের।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগী প্রায় ৭৯ হাজার। দেশটিতে গত এক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ। ভারতে প্রতি ১০ লাখে ১ হাজার ৪১১ জনের পরীক্ষা হচ্ছে, এক মাস আগে যেটি ছিল ১৭৭।

ভুটানে প্রতি ১০ লাখে ১৬ হাজার ৭৬০, নেপালে ২ হাজার ৮০৩, শ্রীলঙ্কায় ১ হাজার ৮৫১ এবং পাকিস্তানে ১ হাজার ৪৯৭ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে আফগানিস্তানে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে ৫০৭ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে মালদ্বীপে। দেশটিতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৭ মার্চ। এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৯৫৫। দেশটিতে গড়ে প্রতি ১০ লাখে ২১ হাজার ৭৮৪ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ।

>

দেশে এখন ৪১টি কেন্দ্রে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে
এসব কেন্দ্রে দিনে ১২ হাজারের ওপর নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলছে, পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষা না হলে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) না থেকে সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। এতে একজনের মাধ্যমে আরও অনেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

কেন্দ্র বাড়ছে, সক্ষমতার ব্যবহার কম

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। আর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ৩০ মার্চ থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রের আওতা বাড়ানো শুরু হয়।

১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ১৭টি। এর মধ্যে ঢাকায় ছিল ৯টি এবং ঢাকার বাইরে ৮টি। গত ২৬ দিনে নতুন আরও ২৪টি পরীক্ষা কেন্দ্র যুক্ত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ৪১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে ৭ হাজার ৩৯২টি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত মিডিয়া সেলের সদস্য ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য অণুবিভাগ) রীনা পারভীন মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার সঙ্গে নমুনা সংগ্রহ এবং অন্যান্য কারিগরি বিষয় যুক্ত রয়েছে। ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হওয়ার একাধিক কারিগরি কারণ থাকতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারের মূল লক্ষ্য পরীক্ষা বাড়ানো। এক মাসের ব্যবধানে পরীক্ষাকেন্দ্র ও পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

কেন্দ্রভিত্তিক পরীক্ষার সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪ এপ্রিল এক দিনে আইইডিসিআরে নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ১ হাজার ৪১টি। অথচ, গত ৭ দিনে আইইডিসিআরে সব মিলিয়ে পরীক্ষা হয়েছে ১ হাজার ৬৫২টি। এর মধ্যে ৯ মে মাত্র ১২৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। অধিকাংশ দিন আইইডিসিআরে ২০০ থেকে ৩০০টি পরীক্ষা হচ্ছে।

আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতে দিনে এক হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করত। কিন্তু ৪ মে থেকে প্রতিষ্ঠানটি বাড়ি গিয়ে আর নমুনা সংগ্রহ করছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পাঠালে তা পরীক্ষা করছে।

শুধুমাত্র করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত রাজধানীর মুগদা হাসপাতালেও একটি পরীক্ষাকেন্দ্র। গত ৮ দিনে এই কেন্দ্রে কোনো পরীক্ষা হয়নি। দেখা যায়, সর্বশেষ ৬ মার্চ পরীক্ষা হয়েছিল ২৩৫ জনের। বন্ধের আগে কেন্দ্রটিতে মোট ২ হাজার ৩৭৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুগদা হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম নবী প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাবরেটরি কক্ষের নকশায় সমস্যা ছিল। তাই পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করিয়ে আনা হচ্ছে। নতুন নকশায় ল্যাব প্রস্তুত শেষে আগামী বুধবার পরীক্ষা শুরু হতে পারে।

জনবল কম তাই এক পালায় পরীক্ষা

বিশেষজ্ঞ ও ল্যাবরেটরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। এতে নমুনা সংগ্রহের কাজ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সঠিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ না করায় কিছু নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্তমানে যে পদ্ধতিতে (আরটি-পিসিআর) শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে।

আরটি-পিসিআর মেশিনে প্রতিবারে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। এতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান ও নমুনা সংগ্রহ করা গেলে একটি মেশিনে দিনে তিনবার পরীক্ষা করা সম্ভব। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজসহ বেশ কিছু কেন্দ্রে দিনে পরীক্ষা হয় একবার। ঢাকার বাইরের দুটি কেন্দ্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ল্যাবে কর্মীর সংকট থাকায় দুই পালায় পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার খুব দ্রুত পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে, এটি প্রশংসার দাবিদার। পরীক্ষা যত বাড়বে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে এবং কমিউনিটিতে (জনগোষ্ঠীতে) সংক্রমণ রোধে তা সাহায্য করবে। তবে মহামারি নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষার অপেক্ষায় বসে থাকার সুযোগ নেই। জ্বর হলে আইসোলেশনে রাখতে হবে এবং লক্ষণ দেখে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।