নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করছি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

১৬ মার্চ, বেলা দুইটা। বিভাগের ২১৪ নম্বর কক্ষে বসে তৃতীয় বর্ষ সমাপনীর চতুর্থ কোর্সের পরীক্ষা দিচ্ছি। এমন সময় পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান স্যার এসে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত বন্ধ হতে যাচ্ছে। আজ-কালকের মধ্যে নোটিশ পেয়ে যাবা। তোমাদের বাকি চার কোর্সের পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন খুলবে, তার চার–পাঁচ দিন পরে হবে এবং সেটা নতুন রুটিনে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। তবুও টানা পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত সবাই হঠাৎ এমন ছুটি পাওয়ায় খুশিই হলো। আর যারা পরীক্ষা ভালো দিতে পারেনি কোনা কারণে, তাদেরও একটা সুযোগ থাকবে এই বন্ধে বাকি কোর্সগুলোর ভালো প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার। সেদিন পরীক্ষা শেষ করে হলে ফিরে শুনি বিশ্ববিদ্যালয় ২ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ। ১৯ মার্চ সকালের মধ্যে হল ছাড়তে হবে।

টিউশনি আছে সন্ধ্যা ছয়টায়। শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে বললাম আজকেই হয়তো শেষ পড়ানো। স্কুল-কলেজও ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ দিয়েছে। অভিভাবক নিজে থেকেও এসে বললেন আর পড়াতে আসার দরকার নেই বাবা। পরিস্থিতি ভালো না, গ্রামের বাড়িতে চলে যেয়ো। এই বলে টেবিলের উপর মাসের অর্ধেক বেতন রেখে চলে গেলেন। আমি সেদিন দুই ঘণ্টা পড়িয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার সিলেবাস কোনোমতে শেষ করে দিয়ে এলাম।

১৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। সকাল থেকেই হলের অনেক শিক্ষার্থী হল ছাড়তে শুরু করছে। রাতে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হলের ডাইনিংয়ে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা আছে। সন্ধ্যার দিকে ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ক্যাম্পাসে হাঁটতে বের হলাম। নানা রঙের আলোয় ক্যাম্পাস আজ আলোকিত। কে কখন বাসায় যাচ্ছি, সবাই সবারটা জানলাম। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে রাতের খাবারের আগে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তখন কে জানত এটাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিদায়! রাতে ঠিক করলাম সকালের ট্রেনেই বাড়ি চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৮ মার্চ সকাল ৮টার ট্রেনে গ্রামের বাড়ি চলে এলাম।

দুই মাস হতে চলল। পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও বাড়ানো হয়েছে। বাইরে কোথাও যেতে পারছি না। এলাকার মানুষ অবশ্য নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে দিব্যি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজে থেকে পরিবার নিয়ে সতর্ক থাকছি। ছোট ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ে। ওকে মাঝেমধ্যে পড়াচ্ছি। আর বেশির ভাগ সময়ই কাটছে গেমস খেলে, টিভি দেখে অনলাইনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চ্যাটিং করে এবং লুডু খেলে।

অঘোষিত এই করোনাকালের লকডাউনে সবাই যেন নিজেদের আবার নতুন করে আবিষ্কার করছি। এরই মধ্যে ক্যাম্পাসের একজন মেয়ে যাকে আমি আগে থেকেই পছন্দ করতাম। সে অবশ্য জানে না যে তাকে পছন্দ করি। তার সঙ্গে বেশি বেশি কথা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। তার সঙ্গে কথা বললে দিনের দৈর্ঘ্য অর্ধেক মনে হয় আমার কাছে। ক্যাম্পাস খুললে একসঙ্গে কিছু সময় কাটাব—এমন পরিকল্পনাও করে ফেলেছি দুজনে।

প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশে করোনার প্রভাব এতটা তীব্র হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো যথা সময়েই খুলবে। আবার দ্রুতই ক্যাম্পাসে ফিরতে পারব। তাই বাড়িতে আসার আগে যে চার কোর্সের পরীক্ষা বাকি আছে, সেই বইগুলোই এনেছিলাম শুধু। দীর্ঘ ছুটির কথা আগেভাগে ঠাহর করতে পারলে হয়তো বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই আনা যেত। এই সময়ে পড়ব পড়ব করে পড়া হয়নি, এমন বইগুলো পড়ে ফেলা যেত। অবশ্য পিডিএফ বই পড়ে পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি।

আবার কবে মুখরিত ক্যাম্পাসে বসে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ছয়টা দুধ–চা আর তিনটা রং চায়ের অর্ডার দেব, টিউশনিটা থাকবে কি না, হলের ডাইনিংয়ে আবার খেতে পারব কি না, মেয়েটার সঙ্গে বসে পৃথিবীর যাবতীয় কিছু নিয়ে আলাপ করতে পারব কি না—এসব যাবতীয় কিছু ভাবতে ভাবতে আর পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে সময় কেটে যাচ্ছে। সবকিছুরই অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আবার সবকিছুই আগের মতোই স্বাভাবিক হবে—এমন সময়ের ক্ষণ গুনছি...।

*লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]