ক্যাম্পাসের ভরপুর জীবনের হঠাৎ থেমে যাওয়া

তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। ছবি: লেখক
তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। ছবি: লেখক
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

তখনো দেশে করোনার খুব একটা প্রকোপ দেখা দেয়নি। বলছি, ১৪ মার্চ রাতের কথা। তখন আমি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ৫১২-পশ্চিম রুমে পড়ার টেবিলে বসে ভাবছি, আমাদের মনে হয় আর ক্লাস করা ঠিক হবে না। ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলাম, অনেকের মধ্যেই এই ধারণাটির সঞ্চার হয়েছে যে আমাদের সতর্ক থাকা জরুরি। ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়া এবং পত্রিকায় করোনা–সম্পর্কিত সংবাদ প্রতিনিয়ত দেখতে থাকাই মূলত ধারণাটির সঞ্চার করেছে।

১৫ মার্চ থেকেই ডিপার্টমেন্টের সবাই ক্লাস বর্জন করতে শুরু করল। এর মধ্যেই ১৬ মার্চ সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯ মার্চ বিকেল পাঁচটার মধ্যে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। ১৮ মার্চ সকালের বাসে খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম বন্ধু আদনানের সঙ্গে।

এর আগে ১৭ মার্চ দৌলতপুর ফুটপাত থেকে সাধারণ মাস্ক কিনি ৫০ টাকায়। বিক্রেতার সঙ্গে দর–কষাকষি করলাম, এই মাস্ক কোনোভাবেই ২০ টাকার বেশি হতে পারে না। বিক্রেতাও নাছোড়বান্দা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সকালে এই মাস্ক অনেকগুলো ঢাকা থেকে এনেছেন অর্ডার দিয়ে। খুলনার কোথাও পাব না। খুলনার দৌলতপুর আনতে সাকল্যে খরচ হয়েছে ৪০ টাকার বেশি। ফলে ৫০ টাকার নিচে দাম বলাটাই নাকি আমার অন্যায্য কথা। কী আর করার! ৫০ টাকায় কিনতে বাধ্য হলাম। যদিও ইচ্ছা ছিল সার্জিক্যাল মাস্ক কিনব। ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বন্ধু আদনানকে ফোন দিয়ে হতাশ হই। সে বলল, সার্জিক্যাল মাস্ক খুঁজে লাভ নেই, পাওয়া যাবে না।

১৮ মার্চ সকালে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস বাসে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসে চড়ে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পৌঁছাতে দুপুর ১২টার কিছু বেশি বেজে গেল। মাওয়া দিয়ে যারা ঢাকা-খুলনাপথে যাতায়াত করি, তাদের জানা আছে, এখানে পদ্মা কয়েকভাবে পার হওয়া যায়। এর মধ্যে লঞ্চ পারাপার অন্যতম। কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকেই মাওয়ার উদ্দেশে লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ চলছে নদীতে, চলতে চলতেই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সঙ্গে দেখা। পদ্মা সেতু যেন বলছে, আমার দেহের ক্রমেই বৃদ্ধি দেখে গর্ব করো, বাংলাদেশ আমার মতো এক বিশাল দেহ সম্পন্ন সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার উদ্যোগ নিয়ে অনেকাংশেই বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে কথা বলতে বলেই ঠিক তার দেহের নিচে চলে এল লঞ্চ। লোভ সামলাতে না পেরে পদ্মা সেতুর সঙ্গে একটা সেলফি তুলে রাখলাম। একটু একটু করে লঞ্চ মাওয়া ঘাটে পৌঁছাল। মাওয়া থেকে আবারও টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস বাসেই গুলিস্তানের উদ্দেশে রওনা দিলাম। বেলা তিনটায় গুলিস্তান এসে পৌঁছালাম। যাত্রাপথে ভুলতেই বসেছিলাম যে করোনার আগাম সতর্কতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দেওয়ায় বাসায় ফিরছি। কারণ, মানুষের মধ্যে সতর্কতা দেখতে পেলাম না। গুলিস্তানে বাহারি রঙের মাস্ক বিক্রি দেখে আবারও মনে হলো কোভিড-১৯–এর কথা। আদনানকে বিদায় দিয়ে, গুলিস্তানের ভিড় ঠেলে নরসিংদী যাওয়ার বাসে উঠলাম। মেঘালয় লাক্সারি বাসে নরসিংদী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এবং সেখান দেখে রিকশায় চড়ে বাসায় পৌঁছালাম আনুমানিক বিকেল পৌনে পাঁচটায়। এটাই ছিল আমার শেষ কোনো পরিবহনে যাত্রা।

বাসায় একেবারেই এক বন্দিজীবনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। ক্যাম্পাসের ক্লাস, পরীক্ষা, টিউশন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ব্যস্ত থাকা জীবন হঠাৎই ঘরবন্দী জীবনে পরিণত হলো। অন্য সময় ছুটিতে বাসায় এলে স্কুল, কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই। এবার বন্ধুদের সঙ্গে এখনো দেখা করা হয়নি। আস্তে আস্তে ঘরবন্দী জীবন মানিয়ে নিচ্ছি।

সিংহভাগ সময় পরিবারের সবার সঙ্গে গল্প করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, বিভিন্ন বই পড়ে, পত্রিকা পড়ে সময়গুলো কেটে যাচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টিউশনি করাচ্ছি। এই তো, সময় চলছে সময়ের সঙ্গে আমরাও চলছি।

তবে আমার বিশ্বাস, সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর দেখা মিলবেই। এই পৃথিবী আরও সুন্দর রূপে সেজে আমাদের স্বাগত জানাবেই।

*লেখক: শিক্ষার্থী, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]