টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও ১০ বছরে...

টাকার অঙ্কে গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় বাজেটে এ খাতের অংশ কমেছে। এ সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের হিস্যা বেড়েছে, তবে মৌলিক চাহিদার এই খাতের বেড়েছে বঞ্চনা। গবেষণাসহ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বরাদ্দ একেবারেই কম।

গত দশকে বাজেটে এই খাতের বরাদ্দ ৬ শতাংশের সামান্য বেশি থেকে ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে শেষ হতে চলা অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশও নয়। এই অনুপাতের প্রবণতাও নিম্নমুখী।

তদুপরি সাম্প্রতিক বছরগুলোর স্বাস্থ্য বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বেতন-ভাতা, ওষুধ কেনাসহ পরিচালন ব্যয়ে। বরাদ্দের বাকিটা এ খাতের উন্নয়নের জন্য থাকে। সেটার আবার বড় অংশই যায় ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পে। গবেষণা ও স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক উন্নয়নের জন্য থাকে খুবই কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এটা ৮৮ ডলার মাত্র। ১২৯ ডলার নিয়ে বাংলাদেশের পরেই আছে পাকিস্তান। ভারত খরচ করে ২৬৭ ডলার। মাথাপিছু প্রায় দুই হাজার ডলার খরচ করে তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে মালদ্বীপ। এরপরই আছে শ্রীলঙ্কা—খরচ করে ৩৬৯ ডলার। বিশ্বে মাথাপিছু স্বাস্থ্য বরাদ্দের শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। খরচ করে বাংলাদেশের ১০৭ গুণ বেশি।

বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা বলেছেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ও অর্থায়ন অনেকটাই গৎবাঁধা ও অবিবেচনাপ্রসূত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ খুবই কম।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, প্রতিবছর বাজেট যা বাড়ছে, তা মূলত বেতন-ভাতা, ওষুধসহ চিকিৎসাসামগ্রী এবং নির্মাণ ও মেরামত খাতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে যাঁরা বাজেট তৈরি করেন, তাঁরা চাহিদার ভিত্তিতে বাজেট তৈরি করেন না। আগের বছরের বাজেটের চেয়ে ৫ বা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পরের বছরের বাজেট তৈরি করেন। আবার অনেকের খরচ করারও দক্ষতা নেই। সে কারণে বাজেট অব্যবহৃত থেকে যায়। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ও মন্ত্রণালয়ে যৌক্তিক বাজেট তৈরি করার মতো দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে।’

১০ বছরে বরাদ্দের চিত্র
২০১০-১১ সালের তুলনায় চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে তিন গুণ বেড়েছে। কিন্তু ১০ বছরে বাজেটের আকারও বেড়েছে প্রায় সোয়া চার গুণ।

প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় ১৫টি খাতে বরাদ্দ ভাগ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ছিল নবম। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে। ১৫টি খাতের মধ্যে এর অবস্থান হয়েছে ১১তম। এই ১০ বছরে বরাদ্দে এগিয়েছে শিক্ষা, যোগাযোগ, জ্বালানির মতো খাতগুলো।

বাজেট বরাদ্দের দুটি ভাগ—উন্নয়ন ও পরিচালন তথা অনুন্নয়ন খাত। উন্নয়ন বরাদ্দে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে চলে প্রকল্প। আর পরিচালন বরাদ্দ খরচ হয় বেতন-ভাতা এবং সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ কেনাসহ আনুষঙ্গিক খাতে।

>

বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশও নয়। মাথাপিছু পড়ে ৮৮ ডলার। স্বাস্থ্যকর্মী ও সেবা অপ্রতুল, উন্নয়ন মূলত ভবন নির্মাণে।

চলতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা পেয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা পরিচালন খাতে। মোট স্বাস্থ্য বাজেটের এটা প্রায় ৫৩ শতাংশ। এটার এক-চতুর্থাংশের মতো বরাদ্দ হচ্ছে ওষুধ ও সরঞ্জামাদি কেনার জন্য। সিংহভাগই যাচ্ছে বেতন-ভাতায়, যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্স এখনো অত্যন্ত অপ্রতুল।

পরিবহন ও যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বা স্থানীয় সরকারের (রাস্তাঘাট নির্মাণ করে) মতো খাতগুলোতে অনুন্নয়ন খরচের চেয়ে উন্নয়ন খরচ অনেক বেশি। শিক্ষায় উন্নয়ন খরচ পরিচালন ব্যয়ের কাছাকাছি। তবে কৃষি বা সমাজকল্যাণ খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও উন্নয়নের চেয়ে পরিচালনের খরচ বেশি।

গত দশকে অবশ্য উন্নয়ন বাজেটের হিস্যা বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এটা ছিল স্বাস্থ্য বাজেটের ৪২ শতাংশ। এ বছর এটা ৪৭ শতাংশের বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়ায় স্বাস্থ্য বাজেটে উন্নয়নের ভাগ বেড়েছে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) রাশেদা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বাজেটে করোনা মোকাবিলাই বেশি গুরুত্ব পাবে। তবে স্বাস্থ্য খাতের নিয়মিত বরাদ্দও থাকবে। তাঁরা এখন খাতওয়ারি বরাদ্দ নিয়ে কাজ করছেন। অবকাঠামো ও জনবলের অসংগতি দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি সম্প্রতি কয়েক হাজার চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের উদাহরণ দেন। সেটা অবশ্য হয়েছে কোভিড-ঝড়ের মুখে।

আর পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর, করোনা তা দেখিয়ে দিল। তাঁর মতে, গরিব মানুষের যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতকে সার্বিকভাবে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করতে হবে।

উন্নয়নের চিত্র ও চাহিদা
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতের ৫৭টি প্রকল্প আছে। প্রকল্পগুলোর ৪৩টি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। বাকিগুলো পরিবারকল্যাণ বিভাগের। মোট উন্নয়ন বরাদ্দ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এটা এডিপির ৬ শতাংশও নয়।

প্রকল্পগুলোর ২৭টিই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভবনসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের, যেখানে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় কয়েকটি প্রকল্প আছে। গবেষণার জন্য প্রকল্প আছে মাত্র একটি, বিষয় মাতৃস্বাস্থ্যের সুরক্ষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে বাজেট তৈরির মতো কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে। সরকারকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। করোনা দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার দায়িত্ব নয়।