দক্ষিণের ছয় জেলায় দুই লাখ টন বেশি চাল উৎপাদনের আশা

কৃষককে বাঁচতে হলে চাষাবাদ করতে হবে। তাই করোনার মধ্যেই প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে খেতে ধানের বীজ ফেলছেন ৭৫ বয়সী এই কৃষক। সম্প্রতি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালতলী গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
কৃষককে বাঁচতে হলে চাষাবাদ করতে হবে। তাই করোনার মধ্যেই প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে খেতে ধানের বীজ ফেলছেন ৭৫ বয়সী এই কৃষক। সম্প্রতি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালতলী গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

খরা, লবণাক্ততা আর বৈরী আবহাওয়াকে জয় করে বরিশাল বিভাগে চালের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। গেল বছর এই বিভাগে আমন, আউশ, বেরো মিলিয়ে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন হয়। এবার তিন মৌসুম মিলিয়ে বিভাগে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ, যা আগের বছরের চেয়ে আড়াই লাখ মেট্রিক টন বেশি। 

কৃষি বিভাগ জানায়, আমন মৌসুমে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন হয়েছে। এখন চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটা চলছে। এবার এ অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় চালের উৎপাদন ছয় লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গত বছরের চেয়ে এবার ৬৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নেমেছেন কৃষকেরা। আউশের উৎপাদনও সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। এর ফলে এ বছর তিন ফসল মিলিয়ে এই বিভাগে মোট উৎপাদন ৩০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষি বিভাগ ও কৃষকেরা বলছেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। শেষ হবে মের শেষভাগে। এবার বোরোর বাম্পার ফলনের কারণে (গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৩ মেট্রিক টন, গত বছর ছিল ৪ দশমিক ২ মেট্রিক টন) এবারও বিভাগে বোরোর উৎপাদন ছয় লাখ মেট্রিক টনের বেশি হবে।

কৃষি বিভাগ বলছে, বোরো তুলতে না তুলতেই এরই মধ্যে দক্ষিণের কৃষকেরা আউশ আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করতে নেমে পড়েছেন। এবার আউশের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর। গতবার তা ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর। গত বছর আউশ উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এবার বেশি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ মেট্রিক টন। এ জন্য ১০ হাজার ৪০০ কৃষককে বীজ ও সার প্রণোদনা দিয়েছে কৃষি বিভাগ।

বরিশাল অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। বরগুনার আমতলী উপজেলার আঠারাগাছিয়া এলাকার একটি বোরোখেত। ছবি: প্রথম আলো
বরিশাল অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। বরগুনার আমতলী উপজেলার আঠারাগাছিয়া এলাকার একটি বোরোখেত। ছবি: প্রথম আলো

একসময় এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ছিল আমন। তাই ৬ জেলায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান উঠে গেলে বছরের ৭ মাস এসব জমির বেশির ভাগ অনাবাদি থাকত। কিন্তু এখন চিরাচরিত সেই প্রথা ভেঙে দক্ষিণের কৃষকেরা আমনের পাশাপাশি সমানতালে বোরো আর আউশ উৎপাদন করে দেশের খাদ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ এক প্রতিবেদন বলছে, বৈরী আবহাওয়া ও নানা সংকটে বিশ্বজুড়ে চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন কমছে। কিন্তু খাদ্য উৎপাদনে এর উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে চালের উৎপাদন দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমেছে। শুধু ভারত ও ভিয়েতনামে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি চালের উৎপাদন বেড়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে, প্রায় ৩ শতাংশ।

বিভাগীয় কৃষি অধিদপ্তর জানায়, দক্ষিণাঞ্চলে প্রধান ফসল ছিল আমন। কিন্তু ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এই অঞ্চলের কৃষকেরা বহুমাত্রিক ফসলের দিকে ঝোঁকেন। তাঁরা এই জমিকে বহু ফসলি করতে আউশের আবাদ শুরু করেন। ৬-৭ বছর ধরে ব্যাপক ভিত্তিক আউশ ধানের আবাদ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে ধানের উৎপাদনে বাড়তি মাত্রা যোগ হয়। আমনকে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় মৌসুম বলা হলেও এখন বোরো-আউশ পাল্লা দিচ্ছে আমনের সঙ্গে।

বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বিভাগে আমন, আউশ, বেরো মিলিয়ে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন হয়। এর মধ্যে আমন হয়েছিল প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমন মৌসুমে বিভাগে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ মেট্রিক টন আমন চাল উৎপাদন হয়েছে। এখন বোরো আর আউশ মিলিয়ে আরও প্রায় ১৩ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে।

এবার ৮ একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামের যুবক সিরাজুল ইসলাম (৩৬)। ফলনও হয়েছে ভালো। সিরাজুল প্রথম আলোকে বলেন, ধান কাটা শুরু করেছি সপ্তাহখানেক আগে। এবার বাজারে দামও ভালো। প্রতি মণ ধান ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক তৌফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার দুর্যোগে যখন সারা পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদন নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে, তখন বাংলাদেশে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরিশাল অঞ্চল দেশের মোট উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখছে। এবারও অন্তত দুই লাখ মেট্রিক টন বেশি খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। তিনি বলেন, দেশের মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আমন ও আউশ উৎপাদন হয় বরিশাল বিভাগে। বোরো উৎপাদনেও এখন বড় অবদান রাখছে এই বিভাগ।