তিনি রান্না করেন, স্বেচ্ছাসেবকেরা পৌঁছে দেন

কাজী তাহমিনার দুই মেয়েও রান্নার সময় সাহায্য করে। ছবি সংগৃহীত
কাজী তাহমিনার দুই মেয়েও রান্নার সময় সাহায্য করে। ছবি সংগৃহীত

নতুন করোনাভাইরাসের বিস্তারে মানুষের কাজ বন্ধ। অনেকের বেতন বন্ধ। ফলে ঘরে খাবার নেই এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। পথের মানুষদের ভোগান্তি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। আর এই মানুষগুলোর জন্য ব্যক্তি উদ্যোগ বা ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। কেউ ঘরে খাবার রান্না করছেন। কেউ রান্না করা খাবারগুলো অভুক্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক কাজী তাহমিনা একদম ছোট পরিসরে পারিবারিক উদ্যোগ হিসেবে কাজটি শুরু করেছিলেন। আশপাশের অভুক্ত মানুষ বিশেষ করে পথশিশুদের এক বেলা খাবার দেওয়ার উদ্যোগ নেন।কাজী তাহমিনা বলেন, 'আমি রান্না করব, তবে এই মুহূর্তে খাবারগুলো বাইরে নিয়ে অভুক্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই রান্না করার আগে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যাবে কি না তা লিখে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিই। পোস্ট দেওয়ার পর স্বেচ্ছাসেবক সৈয়দ সাইফুল আলম এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যাবে। সেই থেকে শুরু। আমি যেদিন যেদিন রান্না করি তার আগে সাইফুল আলমকে জানালে তিনি স্বেচ্ছাসেবক ঠিক করে দেন। রান্না করার পর প্যাকেট করা খাবার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গিয়ে বিতরণ করেন।'

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কাজী তাহমিনা জানালেন, শুরু থেকেই সাংবাদিক স্বামী পলাশ সরকার বাজার করে দেওয়া, রান্না করার সময় সাড়ে ছয় বছর ও দুইবছর চার মাস বয়সী দুই মেয়েকে সামলানোসহ সব কাজেই সহযোগিতা করছেন। মেয়ে দুটিও ডিম ছিলে দেওয়াসহ টুকটাক কাজ করে দেয়। শুক্রবার কাজী তাহমিনা আলু, গাজর, মুগ,মসুর ডাল, নাজিরশাইল চাল, বেশি মসলা, গরুর মাংস ভুনা দিয়ে ৩২ প্যাকেট খিচুড়ি রান্না করেছেন। কাজী তাহমিনা জানালেন, প্রথম দিকে তিনি নিজেই পারিবারিকভাবে রান্নার সব খরচ দিতেন। তবে তাঁর কাজ দেখে এখন অনেকেই স্পন্সর করছেন। ২৯ তম দিনে রান্না শেষে কাজী তাহমিনা ফেসবুকে লিখেছেন, 'আজকের স্পন্সর তৃতীয় দিনের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের আমার এক বছরের জুনিয়র, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছোট বোন।'

খাবার পৌঁছে দেন স্বামী–স্ত্রী:

মোহাইমিনুল ইসলাম ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে সহকারি ব্যবস্থাপক (এইচ আর) হিসেবে কর্মরত। সাধারণ ছুটিতে প্রতিদিন অফিসে যেতে হচ্ছে না। অফিস করতে হলেও হাতে অনেকটুকু সময় থেকে যায়। বললেন, 'করোনাকালে মানুষের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। তাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন জনের রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছি মানুষের কাছে। নিজের মোটরবাইক নিয়েই ছুটছি।'

মোহাইমিনুল ইসলামের গল্পটার এখানেই শেষ নয়। জানালেন, তাঁর কাজে সঙ্গী হয়েছেন স্ত্রী শারমিন আক্তার। হাসতে হাসতে বললেন,' স্ত্রী এমনিতে ভীতু টাইপের। আমি শুরুতে একাই স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছিলাম। মোটরবাইকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে একা চলাচল করা বেশ কঠিন। একদিন ছোট একটা দুর্ঘটনাও ঘটে। তারপর স্ত্রী নিজে থেকেই জানায় সেও আমার সঙ্গে যাবে। এতে করে আমার কাজ সহজ হয়ে গেছে। কেননা, কোনো কোনো দিন তিন জায়গা থেকেও খাবার সংগ্রহ করার দায়িত্ব থাকে। কেউ কেউ ৫০ জনের বেশি মানুষের জন্য খাবার দেন। তবে বাসায় থাকা মাত্র ১৪ মাস বয়সী মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। তাকে দেখার জন্য শ্বশুর–শাশুড়ির জন্যও চিন্তা হয়। তাই আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করে বের হওয়ার চেষ্টা করি। বাসায় ফিরেও সরাসরি গোসলসহ অন্যান্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরই মেয়েকে কোলে নিই।'

মোহাইমিনুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তার একসঙ্গে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। ছবি সংগৃহীত
মোহাইমিনুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তার একসঙ্গে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। ছবি সংগৃহীত

মোহাইমিনুল ইসলাম দম্পতি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন সিএসআর ইউন্ডো বাংলাদেশের 'কাইন্ডনেস ক্যাম্পেইন' এর 'পাশে আছি' নামের উদ্যোগে। করোনাভাইরাস বিস্তারের শুরুতে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি রাজধানীতে এ উদ্যোগটিও শুরু করে।সিএসআর উইন্ডোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি জানালেন, তাঁরা ১৬ মার্চ থেকে করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের কোনো লেনদেন হচ্ছে না। বিভিন্ন করপোরেট সংস্থা সংস্থার সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছে। অন্যদিকে প্রকল্পগুলোতে যার যে দক্ষতা আছে সেই দক্ষতাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে। যেমন গত ২২ এপ্রিল থেকে পাশে আছি প্রকল্পে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। যিনি রান্না করতে পারেন তাঁর রান্নার দক্ষতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে, আবার যে স্বেচ্ছাসেবক সাইকেল বা বাইক চালান তাঁদের সে দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

আহসান রনি জানালেন, স্বেচ্ছাসেবক হতে ইচ্ছুক এবং রান্না করা খাবার দিতে চাচ্ছেন এই মানুষগুলো ফেসবুক পেইজ, ওয়েবসাইট, ই–মেইল বা টেলিফোনে ( ০১৯০৯১১০৬০০, ০১৯০৯১১০৬০৪, www.csrwindow.com) যোগাযোগ করেন। কোন এলাকায় কোন স্বেচ্ছাসেবক আছেন সে অনুযায়ী তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফেসবুক পেইজে কে খাবার দিলেন স্বেচ্ছাসেবক বা 'অ্যাম্বাসেডর' হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করলেন সে সব তথ্য দেওয়া হয়। কিছু ছবি এবং ভিডিও আপলোড করা হয় কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য।
কাজী তাহমিনা বললেন,'স্বেচ্ছাসেবকেরা এগিয়ে এসেছেন বলেই আমি আমার রান্না করা খাবার অভুক্ত মানুষগুলোকে খাওয়াতে পারছি। আসলে এ উদ্যোগে দুই পক্ষের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।'