অবসরের সুখ আর ভালো লাগছে না

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সব বদলে গেছে বলতে হয়। ঘুম সময়মতো হয় না। খাবারও ঠিকমতো না। কেমন যেন অদ্ভুত সময় কাটছে! মাঝেমধ্যে মনে হয় আরও ভয়ংকর দিন অপেক্ষায় আছে আমাদের জন্য। কেমন ব্যস্ত দিনগুলো, রাতগুলো অলসতায় ভরে গেছে আজ। দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে রোজ! সময়গুলো হতাশার। খুব ক্লান্ত লাগছে কাটাতে মুহূর্ত!

এমন কিছুদিন ক্লান্তিতে খুঁজত একটু অবসর। গৃহের অনাবিল মায়া কাছে টানত। চাইত অনেক মানব মন একটু প্রশান্তি! আজ শত সুযোগ গৃহের মায়ায় কাছে নিয়েছে তাদের। আপনের কাছে যত দিন খুশি থাকা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা আর নিতে পারছি না মায়া। আর ভালো লাগছে না অবসরের শত সুখ।

কর্মহীন দিনগুলো যেন ভূতের মতো লাগছে! বাইরে কাজের জন্য মরিয়া মানুষগুলো হাঁপিয়ে উঠেছে গৃহের আদরে। আর কত! নাভিশ্বাস উঠছে যেন। কোনো কোনো নারী–পুরুষ বাজারের কারণে বাইরে গিয়ে চেনা শহরকে অচেনা ভেবে অনুভব করছে বন্দী থাকার বেদনা। বাইরের শ্বাস নিতে যেন মধুর লাগে! দুদণ্ড শান্তি। বাজার শেষে ফেরে আবার বন্দিজীবনে।

এই প্রথম এই শতাব্দীতে মানুষ একটি বড় রকমের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। যে পরিবর্তনের আগাম কোনো নোটিশ ছিল না। যদি নোটিশ থাকত সংবাদপত্রে বড় বড় বোল্ড শিরোনাম হতো। মানুষ অনেকটা আগে গবেষণা করে ফেলত এই ভাইরাসের এপিঠ–ওপিঠ। এমনি একসময় আমরা অতিক্রান্ত করছি যার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য লুকিয়ে যেতে হলো শ্রেষ্ঠ মানবজাতিকে।

ইতিমধ্যে করোনার ছোবল কেমন হতে পারে আমাদের অনুভবে গিয়েছে। কয়েক মাসে করোনা অনেক অমানবিকতা ঘটিয়েছে দেশে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, মুহূর্তের সাক্ষী আমরা হয়ে গেলাম। তবে ঝড় শেষে আশার বাতাসও আমরা খুঁজছি। সুখ প্রশান্তি যে নিজের মধ্যে। তা–ও বের করে আনতে হয়। নিজের সেরাটা বের করে আনার মোক্ষম সময়। স্বজনদের একান্ত চাওয়া পাশে থাকা। তা–ও পূর্ণ। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় আমাদের করোনার দিন। করোনার এই ভালোবাসার দানে আমরা সত্যি ভরপেট হয়ে গেছি। আর পারছি না খেতে।

প্রতিটি পেশার মানুষ নিয়ে নানা অভিযোগ কমন ব্যাপার। তবে এই সময়ে ডাক্তারদের ভালোমন্দ বেরিয়ে আসছে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। যদিও এসব দেখে দেখে আমরা মানিয়ে নিয়েছি, তথাপি পুরোনো মদে নতুন মদের গন্ধ ভোগ করতে হয়েছে উৎকট স্বাদে।

দেশে এত চোর আড়ালে, ভালো মানুষের মুখোশে বসে ছিল আমাদের আশপাশে। করোনা না এলে আমরা বুঝতামই না। এই দেশটি অনন্তকাল কেবল সম্পদ হারিয়ে দিশাহারা। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। স্বদেশেই এত লুণ্ঠনকারী, তা–ও দায়িত্ববানরা, ক্ষমতায় থেকে। আজ পাঁচ বছরের বাচ্চাও বোঝে চাল চোর কে? মা–বাবা, স্বজনরা টিভি স্ক্রিনে দেখছেন চাল চোরের খবর। সঙ্গে বাচ্চারাও। অন্যায়গুলো দেখে এই শিশুরা যদি সঠিক পথে নির্দেশনা পেয়ে এগোতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে এদের পথ হবে সুন্দর।

করোনা আপনজনদের ছিনিয়ে নিচ্ছে। অপর দিকে করোনা অনেক দূরে চলে যাওয়া পরিবারকে কাছে আনতে সহযোগিতা করছে। সেই নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পরিবার যেমন হাসি-আনন্দে যৌথ পরিবেশে ছিল, তা ফিরে এসেছে। পুরুষ মানুষ একাধারে গৃহে বসবাস, এই প্রথম করোনার সৃষ্টি।

গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি চলছে। দেশের জনগণকে অবাধ চলাচল রুখতে ও জীবন বাঁচাতে এই কঠোরতা প্রয়োজন ছুটি দিয়ে। কিন্তু সেই আশা নিমেষে শেষ হলো যখন কলকারখানা খুলতে গিয়ে হয়রানি, ছলচাতুরি। এপ্রিল শেষে লকডাউন সীমিতকরণ, রেস্তোরাঁ খোলা! ব্যস! বাঙালি সুযোগে ছুটল বাহির পানে। ফলাফল মৃত্যুর দৌড়ে স্পিড বাড়া, আক্রান্তের হারে তীব্রগতি।

এখনই যদি সরকার কঠোর হয়, আবার তবে এই গতিতে শ্লথ আসতে পারে। এত অমানিশার পরেও ভোর আসবেই। সুন্দর, নতুন আরেক পৃথিবীর অপেক্ষায় সচেতন যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গৃহে আজও আছে। মনে মনে জপে যাই একদিন সত্যিই মুক্তি হবে। নতুন পৃথিবীর অসম্ভব সুন্দর কিছু দেখার প্রত্যাশায় দিন গুনি।

* লেখক: কথাসাহিত্যিক, ফেনী। বর্তমানে ঢাকায় আছেন। [email protected]