করোনা তুমি থেকে যাও...

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ঘরবন্দীর ৪৫তম দিন পার করে ফেলেছি। যদিও এর মাঝে কয়েকবার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আর কিছু ওষুধ কিনতে ঘরের বাইরে যেতে হয়েছিল। তবে তা আমায় মুক্তির স্বাদ দেয়নি। বাড়ির পাশেই মুদি দোকান, ফার্মেসি থাকায় কেবল আট থেকে দশ মিনিটের জন্যই বের হতে পেরেছিলাম। এটা অনেকটা, পেছনে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করার মতোই অস্বস্থিকর ব্যাপার। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ইশ, যদি আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম, ঘুরতে পারতাম খোলা আকাশের প্রাকৃতিক ছায়া; বৃক্ষের সারি ধরে ধরে! কেননা প্রথম দিকে খুব বিরক্ত লাগছিল বন্দী হয়ে বসে থাকতে। আর এখন এটা অনেকটা আমাদের নিয়মেই পরিণত হয়ে গেছে। এখন আর ঘরের বাইরে গেলেও ইচ্ছে হয় না ঘুরে বেড়ানোর। কারণ আমার এ অসুস্থ নগরীর আকুতি-আর্তনাদ আমাকে খুব বিষণ্ন করে।

হঠাৎ করেই এমন নগ্ন হয়ে যাবে এ নগরী, কে জানত? এমন শব্দহীন নির্জন নগর গত কয়েক প্রজন্মও দেখেনি। আজ প্রকৃতির নিয়মে চলছে মানুষ। হাজারো ক্ষমতার অধিকারী হলেও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটা যে মানুষের নেই! আজ মানুষকে থামিয়ে দিয়ে প্রকৃতি ছুটছে আপন গতিতে হয়তো মানুষের সমানে সমান এসে আবারও সুযোগ দেবে মানুষকে। কেননা প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ যে নিজ হাতে প্রকৃতিকে বেঁধে রেখে ছুটেছিল নিজেরা। হয়তো করোনা এসেছে সমতা ফেরাতে!


মৃত্যুভয়টাও এখন অনেক বেড়ে গেছে। যখন শুনি সমবয়সীরাও অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে আর মারাও যাচ্ছে, তখন একা হয়ে ভাবি, অনেক কিছুই তো দেখা বাকি, অনেক কিছু জয় করা বাকি। আর মনেপ্রাণে দোয়া করি, সৃষ্টিকর্তা যেন সবাইকে আরও একবার সুযোগ দেন। যেন আরও একবার প্রকৃতিকে সঙ্গী করে পৃথিবী জয়ের আনন্দে মেতে উঠতে পারি আমরা।

এই প্রাণঘাতী করোনা আমাদের নিঃস্ব যেমন করেছে, তেমনি ভরিয়েও দিয়েছে। মানুষের বিলাসিতা কেড়ে নিয়েছে। তবে মানুষকে আরও বেশি ধার্মিক বানাতে একটুও ব্যর্থ হয়নি করোনা। যা সত্যিই খুব আনন্দের পাওয়া আমাদের জন্য।

তবে আরও কিছু হারানো আর প্রাপ্তির বর্ণনা রয়েছে। হারানো বিষয়গুলো আমাদের মানসিক স্বস্তি না পাওয়ার কারণ হলেও প্রাপ্তির বিষয়গুলো হতে পারে আমাদের মানসিক এবং শারীরিক, উভয় দিকেই সুস্থ আর স্বস্তিতে থাকার কারণ।

এ নগরীর রেললাইনে আজ মরচে পড়ে গেছে। মানুষের কোলাহল নেই, নেই কোনো আমেজ। চারদিকে শুধু বিষণ্নতার ছোঁয়া। যদিও তা সুখের কথা নয়। তবে সুখের কথা হলো, এ নগরীর ফুটপাতে ইটের ফাঁকে বাহারি ঘাস বেড়িয়ে আসছে জগৎ দেখতে। নগরীর নদীগুলো যেন প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে। বিশুদ্ধ করছে নিজেকে আর বিশুদ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে নদী থেকে নদীতে। বিশুদ্ধ বায়ুতে আপন সুখে উড়ছে দলে দলে পাখি। বনের প্রাণীরা আজ মানুষের রাস্তায় হাঁটে..কী অপরূপ!

কেন হচ্ছে এসব? কারণ মানুষ যে আর উন্নতির দোহাই দিয়ে কলকারখানার বর্জ্য পানিতে ফেলছে না! পানীয়র বোতলটা ঢিল মেরে রাস্তার ছুড়ে ফেলছে না। অধিক মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে না। কেউ ইচ্ছেমতো অবহেলায় পরে থাকা গাছ–ঘাসগুলোকে মারিয়ে দিচ্ছে না।

তবে খুব ভয় হয় এই নগরীর জন্য, এই অপরূপ প্রকৃতির জন্য। মানুষ ফিরে এসে আবার প্রকৃতির সাজানো রাজ্য ধ্বংস করে দেবে না তো?

সৃষ্টি যিনি করেছেন, তাঁর ইবাদাত ছেড়ে দেবে না তো? কেবল এসব ভয়ের কারণেই মাঝেমধ্যে মনে হয় যদি মানুষের খাবারের কষ্ট, শারীরিক-মানসিক কষ্ট না হতো, মৃত্যুর ঘ্রাণে বিশ্ব ছেয়ে না যেত; তাহলে বলতাম, করোনা তুমি থেকে যাও...।

*লেখক: এইচএসসি পরিক্ষার্থী, জয়দেবপুর, গাজীপুর। [email protected]