বিপণিবিতানে স্বাস্থ্যবিধি আছে, চেনা ভিড় নেই

তাঁরা মানছেন না সামাজিক দূরত্ব। পলয়েল মার্কেটের সামনের চিত্র। নয়া পল্টন, ঢাকা, ১৬ মে। ছবি: হাসান রাজা
তাঁরা মানছেন না সামাজিক দূরত্ব। পলয়েল মার্কেটের সামনের চিত্র। নয়া পল্টন, ঢাকা, ১৬ মে। ছবি: হাসান রাজা

স্বাস্থ্যবিধি মেনেই রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো খুলতে শুরু করছে। তবে ক্রেতার সাড়া নেই। নয়া পল্টনের গাজী ভবনের সামনে জ্বর মাপার যন্ত্র, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক স্প্রে নিয়ে পিপিই গায়ে দেওয়া কর্মীরা দাঁড়িয়ে। দু-একজন করে যাঁরাই কেনাকাটার জন্য আসছেন, তাঁদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শরীরের তাপ মেপে হাতে-গায়ে জীবাণুনাশক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। সিঁড়ির ওপরে বিছানো আছে জীবাণুনাশকে ভেজানো পাপোশ। তার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় জুতোও জীবাণুমুক্ত হচ্ছে। মার্কেটের ভেতরেও প্রতিটি দোকানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সতর্কতামূলক বক্তব্য লেখা স্টিকার লাগিয়ে রাখা হয়েছে।

গাজী ভবন রাজধানীর মধ্য এলাকার এটি বেশ জনপ্রিয় বিপণিবিতান। এখানে পাইকারি ও খুচরা উভয় প্রকারেরই বেচাকেনা চলে। মার্কেট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মামুনের ক্লিওপেট্রা, চ্যালেঞ্জার ও লামিয়া কালেকশন নামের তিনটি দোকান। তিনি জানান, গত ২৫ মার্চ বন্ধ হওয়ার পর গত ১৪ মে বৃহস্পতিবার থেকে তাঁদের এই বিপণিবিতান খুলেছে। যদিও গত ১০ তারিখ থেকেই ঈদ উপলক্ষে বিপণিবিতানগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবু তাঁরা ক্রেতা এবং দোকান মালিক ও কর্মচারীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার পরেই বৃহস্পতিবার থেকে দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছেন। এখান ঈদের আগের নয়-দশ দিনে কিছু খুচরা কেনাবেচা হবে। তাতে কর্মচারীদের বেতন-বোনাসটা হয়তো হবে। কিন্তু দুই মাস ধরে তাঁদের যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়ে গেল, তা পোষাবে না। বিশেষ করে ঈদ সমানে রেখে তাঁরা গত বছর ডিসেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারি থেকেই চীন ও ভারত থেকে পোশাক আনার জন্য এলসি করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি নাগাদ এসব মাল আসতে শুরু করে। তাঁরা বরাবরের মতোই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন শবে বরাতের দিন থেকেই সারা দেশের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মাল পাঠানো শুরু করবেন। কিন্তু তত দিনে লকডাউন পরিস্থিত শুরু হয়ে যায়। সব মাল গুদামে পড়ে আছে। এসব মালামাল কী হবে, এটা ভেবেই তাঁরা প্রায় দিশেহারা।

কথা হলো, এই মার্কেটের পুরুষদের পোশাকের দোকান মালিহা ফ্যাশনের মালিক নূরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, বরাবর ঈদে চিনের পোশাকেরই প্রাধান্য থাকে। এবার অনেকেই চীন থেকে বেশি মাল তাঁরা আনতে পারেননি। ভারতীয় পোশাকই বেশি। জিনস প্যান্টের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা, ভারতীয় ফুল শার্ট ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার এবং চিনের ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। টি–শার্ট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।

মেয়েদের পোশাকের দোকান ইয়েলো কালেকশনের মালিক আবদুল মান্নান জানান, তাঁর দোকানেও এবার পাইকারি বিক্রি হয়নি। অল্প কিছু করে খুচরা বিক্রি হচ্ছে, এতে কর্মচারীদের বেতন আর ঈদের বাজার খরচ হয়তো হবে। এখানে মেয়েদের পোশাকের মধ্যে আছে আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার টাকার লেহাঙ্গা, ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার টপস, স্কার্ট-টপস সেট এক থেকে তিন হাজার টাকা, লং গাউন দুই থেকে চার হাজার টাকা। বাচ্চাদের স্কার্ট-টপস সেট ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

গুলিস্তান এলাকায় ঈদের কেনাকাটা করছেন কেউ কেউ। ঢাকা, ১৬ মে। ছবি: হাসান রাজা
গুলিস্তান এলাকায় ঈদের কেনাকাটা করছেন কেউ কেউ। ঢাকা, ১৬ মে। ছবি: হাসান রাজা

এই এলাকায় পলওয়েল মার্কেট বেশ পুরোনো। এখানেও পাইকারি ও খুচরা পোশাক, জুতো, প্রসাধনী এসবের কেনাবেচা চলে। নাবিল এন্টারপ্রাইজ পোশাকের একটি বড় দোকান। এখানে পুরুষ ও নারীদের পোশাকের সঙ্গে প্রসাধনীও পাওয়া যায়। মালিক সুমন মাহমুদ জানান, মার্কেটে তাঁর আরও একটি দোকান রয়েছে। ঈদুল ফিতরই হলো দেশে পোশাক-আশাকের সবচেয়ে বড় ব্যবসার মৌসুম। সে কারণে প্রায় তিন কোটি টাকার মালামাল আমদানি করতে এলসি খুলেছিলেন তিনি। ভারতের কলকাতা ও মুম্বাই এবং চিনের গুয়াংজু থেকে এসব মালামালের অধিকাংশই চলে এসেছিল। ফেব্রুয়ারির প্রথম নাগাদই মালামাল গুদামে তুলে বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। এর মধ্যই এই করোনা পরিস্থিতি। সব মালামাল আটকে আছে।

এখানেই কথা হলো সিপাহিবাগ থেকে কেনাকাটা করতে আসা সস্ত্রীক নূরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, এই এলাকায় চার–পাঁচটি বড় বিপণিবিতান আছে, আর দামও বেশি রাখে না। তাই সিপাহিবাগ, মুগদা, মানিকনগর এসব এলাকার ক্রেতারা সাধারণত এখানেই কেনাকাটা করতে আসেন। পলওয়েলেও জ্বর মেপে, স্যানিটাইজড করে ক্রেতাদের প্রবেশ করানো হচ্ছে। এ ব্যাপারটি এই দম্পতির পছন্দ হয়েছে। তবু কিছু তো ঝুঁকি আছে, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতেই হবে। সে কারণেই আস বলে জানালেন তাঁরা।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সামাদ সুপার মার্কেটের সামনে ক্রেতা–দর্শনার্থীদের জীবাণুনাশক দেওয়া হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী, ঢাকা, ১২ মে। ছবি: হাসান রাজা
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সামাদ সুপার মার্কেটের সামনে ক্রেতা–দর্শনার্থীদের জীবাণুনাশক দেওয়া হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী, ঢাকা, ১২ মে। ছবি: হাসান রাজা

সিটি হার্ট শপিং সেন্টার গিয়ে দেখা গেল সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রেতাদের প্রবেশ করতে হচ্ছে, তবে ক্রেতা খুব কম। শাড়ির দোকান স্মরণিকা বস্ত্রালয়ের মালিক হারুন-অর রশীদ জানান, ১৩ মে থেকে তাঁরা দোকান খুলেছেন, কিন্তু বেচাকেনা তেমন নেই। লোকে সেভাবে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। তাঁর এখানে সব রকম শাড়িই আছে। টাঙ্গাইল সুতি শাড়ির দাম ৬০০ থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। জামদানি ১ হাজার ২০০ থেকে ১৫ হাজার, মিরপুরের সিল্ক-কাতান ১ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার, জর্জেট ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার এবং বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় শাড়ি ১ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে পাওয়া যাবে। কথা হলে ২৯ বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সদ্য নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক নাবিলা আনসার খানের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, কারোনার কারণে কাজের চাপ বেশি। একটু সময় পেয়েছেন, তা ছাড়া মার্কেটে এখন ভিড় কম, তাই ঈদের কিছু কেনাকাটা করতে এসেছেন। বিপণিবিতানগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি যেভাবে মানা হচ্ছে, তা পুরোপুরি নিরাপদ নয়, তবে যেটুকু আছে, না থাকার চেয়ে তা ভালো বলে মন্তব্য করলেন তিনি। 

জোনাকি সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখা গেল একই অবস্থা। দোকানপাট খুলে ক্রেতার অপেক্ষা করছেন বিক্রেতারা। তৈরি পোশাকের বড় দোকান রাফিয়া ফ্যাশনের মালিক রশিদুল ইসলাম বলেন, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু রোজার সময় ক্রেতারা সাধারণত সন্ধ্যা থেকে রাতেই বেশি কেনাকাটা করেন। সময়টি বদলে বেলা তিনটা থেকে রাত দশটা করলে ভালো হতো।

আজ শনিবার গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা গেল ফুটপাত দিয়ে প্রায় আগের মতোই হরেক পণ্যের পসরা বসে গেছে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর অনেক দোকানও খুলে গেছে। দু-একজন করে ক্রেতাও আসছেন। তবে ঈদের আগের দিনগুলোয় ঢাকার বিপণিবিতানগুলোতে যে উপচেপড়া ভিড় আর বেচাকেনার তুমুল ব্যস্ততা দেখা যায়, সেই চেনা ছবি এবার নেই।