মানবিক সহায়তার তালিকা: এক মুঠোফোন নম্বর ৪০টি নামের পাশে

করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষদের সহায়তায় নগদ আড়াই হাজার টাকা করে দিচ্ছে সরকার। তবে নগদ প্রণোদনার তালিকা তৈরি করতে গিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। তালিকায় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বিত্তশালীদের নাম-ফোন নম্বর, আছে একাধিকবার এই ফোন নম্বর ব্যবহারের অভিযোগ।

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার এক এলাকার একটি তালিকায় ৪০ জনের নামের পাশেই দেওয়া হয়েছিল একই ফোন নম্বর। পরে অবশ্য এই অসংগতি নজরে এলে তা সংশোধন করা হয়। জানা যায়, নম্বরটি খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রাকিব হাসানের।

যেহেতু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ওই টাকা প্রদানের কথা, তাই তালিকায় একাধিক নামের পাশে জেনেবুঝেই একই ফোন নম্বর দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তালিকা চূড়ান্তের আগে যাচাই–বাছাইয়ে এমন আরও অনেক অসংগতি ধরা পড়েছে। একই ধরনের অভিযোগ জেলার অধিকাংশ উপজেলাতেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাটের একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক জনপ্রতিনিধিই তালিকা করতে গিয়ে প্রভাব খাটিয়েছেন। একই ফোন নম্বর ব্যবহার ছাড়াও প্রবাসী, বিত্তশালীদের নাম-ফোন নম্বর তালিকায় দিয়েছেন। যাচাই-বাছাইয়ে আমরা এমন অসংগতি পেয়ে সংশোধন করেছি।’

মূলত করোনায় মানবেতর জীবন কাটানো লোকজনকে দেওয়া সরকারের নগদ সহায়তার অর্থ আত্মসাতের জন্য এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, দ্রুততার সঙ্গে তালিকা করতে গিয়ে এমন ভুল হয়েছে তাঁদের। আর যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব অসংগতি সংশোধন করেই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।

সারা দেশে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবার নগদ এই সহায়তা পাবে। গত বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জানা গেছে, চলতি মে মাসের শুরু থেকে এই তালিকা প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়। তালিকায় নাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরসহ প্রত্যেকের মোট ২৪টি তথ্য দিতে বলা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড সদস্যরা স্থানীয় গণ্যমান্যদের সহায়তা নিয়ে তালিকা তৈরি করেন। ইউপি সদস্যরা প্রথমে তালিকা তৈরি করে জমা দেন চেয়ারম্যানদের কাছে। এরপর চেয়ারম্যানরা ওই তালিকা জমা দেন উপজেলা পরিষদে। সেখানেই মূলত যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে নানা অসংগতি। পরে যাচাই-বাছাই ও কয়েক দফা সংশোধন করা হয়েছে ওই তালিকা, যা পাঠানোর শেষ দিন ছিল গতকাল শনিবার।

শরণখোলায় ৪০ জন সুবিধাভোগীর নামের পাশে নিজের ফোন নম্বর প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য রাকিব হাসান বলেন, ‘চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রতিটি ওয়ার্ডে তালিকা তৈরির জন্য ৮ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। আমার ওয়ার্ডে আমাকে সভাপতি করা হয়। আমরা সবাই মিলে ওই তালিকা তৈরি করেছি এবং সরকারনির্ধারিত ফরমে সবার ফোন নম্বরসহ সব তথ্য দিয়েছি। কিন্তু পরে ওই তালিকা টাইপ করে পাঠানোর সময় আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যকেন্দ্রের কর্মী আবুল হোসেন ওই ভুল করেছেন। আমরা তালিকার জন্য যে ফরম পূরণ করে দিয়েছি, সেখানে প্রত্যেকের ফোন নম্বরই দেওয়া হয়, যা উপজেলা প্রশাসনের কাছে জমা আছে।’

জানতে চাইলে মো. আবুল হোসেন অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর কাছে যে তালিকা আসে, তাতে ফোন নম্বর ছিল না। পরে মেম্বার সাহেবের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করেই তাঁর নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি ইউএনও অফিস থেকে জানানো হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রত্যেকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে সবকিছু ঠিক করে পাঠানো হয়েছে।

তালিকায় একই ফোন নম্বর একাধিকবার আসা ছাড়াও অনেক বিত্তশালীদের নামও এসেছে। এ বিষয়ে শরণখোলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে তলিকা করার সময় একজন ইউপি মেম্বারের ফোন নম্বর ৪০টি জায়গায় চলে আসে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি দাবি করেন, যিনি ওই তালিকা কম্পোজ করেছেন, তিনি ভুল করেছেন। পরে তিনি বিষয়টি সংশোধন করে পাঠান। পাশাপাশি অন্য যে অসংগতিগুলো ছিল, তা সমাধান করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলাতেও। সেখানকার হোগলাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রমজান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ১১ জনের নামের পাশে নিজের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন তিনি। তবে তিনি দাবি করেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে তালিকা করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছিল। আমরা আসলে জানতাম না এই ফোন নম্বরে টাকা দেওয়া হবে। পরে শিক্ষকদের নিয়ে ওই তালিকা সংশোধন করে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে। এখন কোনো ভুল নেই।’

মোরেলগঞ্জের ইউএনও মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এক নম্বর একাধিকবার দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিকভাবে তালিকা তৈরির সময় কিছু ভুলভ্রান্তি ছিল। চূড়ান্ত তালিকাতে কোনো ভুল নেই।

নগদ সহায়তার এই তালিকায় মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হাজার ২০০ জন এবং শরণখোলায় ১ হাজার জনের নাম রয়েছে। একই নম্বর প্রদান ছাড়াও প্রাথমিকভাবে তালিকা তৈরিতে প্রতিটি উপজেলাতেই পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি ও বিত্তশালীদের নাম আসার অভিযোগ ওঠে। তাই প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষক ও গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাইয়ের পর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনওরা।