করোনা-কালে দিনরাত্রি, কিছু উপলব্ধি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমরা এখন যে সময়ে বসবাস করছি, এটা আমাদের জন্য এক অভূতপূর্ব সময়। এই তো কয়েক মাস আগেও কেউ কি ভেবেছিল আমাদের চিরচেনা পৃথিবীটা এভাবে পাল্টে যাবে চিরদিনের মতো! প্রতিদিন সকালে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠি, সবকিছু কেন যেন এখনো বিশ্বাস হয় না। পুরো ব্যাপার স্রেফ একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করার কারণে আপাতত আমাকে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত একজন শনাক্ত হওয়ার অল্প কয়েক দিন পরই ঢাকার বাসায় বসে অফিসের কাজ করা শুরু করি। সবকিছু যখন নিজের মতো করে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছি, সেই সময় হঠাৎ করে সরকারি ছুটির ঘোষণা এল। সব রকম গণপরিবহন তখনো কিন্তু চলছে।

আব্বু-আম্মু তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাকে নিজ বাসায় চলে যাওয়ার জন্য ফোন দিচ্ছে বারবার। এখান থেকে আমার বাসার দূরত্ব হুট করে চলে যাওয়ার মতো নয়, এ ছাড়া পথে-ঘাটে মানুষের ঢল। এই অবস্থায় কোথাও বের হওয়া মানে করোনার বিস্তারে নিজের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলা। তাই সবকিছু চিন্তা করে ঢাকাতেই থেকে গেলাম।

তবে সেদিনই বুঝতে পেরেছি, অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে গেলাম এই নগরীতে। একটু পরপর অবশ্য বাসায় ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিই। আমরা পরিবারের সবাই বলতে গেলে এখন বিভিন্ন জেলায় এক রকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। আমি আছি এক জায়গায়, আব্বুকে থাকতে হচ্ছে তার কর্মস্থলে এবং আম্মু, ভাইবোন, দাদা-দাদি সবাই অন্য এক জায়গায়। আম্মুর ডায়াবেটিস আছে, দাদা-দাদিরও বয়স হয়ে গেছে অনেক; যে কারণে একটু বাড়তি চিন্তা কাজ করে। সবাইকে বলি বাসা থেকে একদমই বাইরে বের না হতে। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের কথা শুনছে না, এ রকম অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি অনেক। আমার ক্ষেত্রে আপাতত সেই সমস্যা হচ্ছে না। তবে আমার ছোট ই কলেজ বন্ধ থাকায় বাসায় গিয়ে মুঠোফোন আর ঘুম নিয়ে বেশি ব্যস্ত এখন, এই সমস্যার নাকি সমাধান হচ্ছে না।

কারও কারও সঙ্গে হয়তো তেমন যোগাযোগ ছিল না, বাসায় এভাবে বন্দী থেকে এখন কথাবার্তা হচ্ছে। এই ক্ষুদ্র ভাইরাস আমাদের জন্য অনেক কষ্ট বয়ে নিয়ে এসেছে সত্যি, তবে একই সঙ্গে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাটুকুও যে বাড়িযে দিয়েছে, সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? আমাদের অনেক কিছুই ছিল, যার মূল্য আমরা বুঝতে পারিনি। সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে আড্ডা, ছুটির দিনে দলবেধে সিনেমা দেখতে যাওয়া কিংবা পথে–ঘাটে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ানোর মতো ব্যাপারটুকুও কত আকঙ্ক্ষিত হয়ে গেছে এখন! জীবনের যেসব সমস্যার কথা চিন্তা করে দুঃখ করতাম, এখন সেসব চিন্তা করে হাসি পায় কিছুটা। সমস্যাপূর্ণ সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য এখন সবার মতোই আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।

শুরুতে বলেছিলাম, বাসায় বসে অফিসের কাজ করার কথা, তার কিছুদিন পরই অবশ্য বেকার হয়ে গেছি। চাকরি-বাকরি না থাকার একটা সুবিধা হচ্ছে, হাতে অনেক সময় থাকে। এখন বই পড়তে পারছি অনেক, মাঝেমধ্যে কিছু সিনেমা দেখা হচ্ছে। রান্নাবান্নাও করছি টুকটাক কিংবা বলা যায়, একা থাকার কারণে করতে হচ্ছে। অনেক ওয়েবসাইট তাদের বেশ কিছু কোর্স উন্মুক্ত করে দিয়েছে, সেখান থেকে নিজের পছন্দের কিছু কোর্স করছি। এবং এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে নিজেকে একধরনের প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছি যে আমি শুধু শুয়ে-বসে দিন যাপন করছি না।

প্রথম দিকে অবচেতন মনে করোনাভাইরাস নিয়ে নেতিবাচক খবরগুলো বেশি পড়া হলেও এখন তা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য এই মুহূর্তে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করার বিকল্প নেই। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন এই মহামারির হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে। যে দেশগুলো এই সময়ে মেতে থাকত যুদ্ধ-সংঘাতের মতো ধ্বংসাত্মক কাজে, তারা এখন অর্থ ঢালছে গবেষণায়। গত কয়েক মাসের গবেষণায় আমরা আসলে এগিয়ে গেছি অনেক বছর, দেরিতে হলেও এ ধরনের মহামারির ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পুরো পৃথিবীতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এবং মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছেই, তখন সম্ভাব্য ভ্যাকসিন কিংবা অন্য কোনো সাফল্যের খবর মানসিক প্রশান্তি দিচ্ছে একটু হলেও।

অন্যদিকে যৎসামান্য সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও আমাদের দেশের ডাক্তার-নার্সরা করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন, বিদ্যানন্দসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কী অসাধারণ সব কাজ করে যাচ্ছে। এই দুর্যোগ যেদিন শেষ হবে, সেদিন যেন আমরা আমাদের সত্যিকারের এই সুপারহিরোদের ভুলে না যাই।

একটি লেখা পড়ছিলাম যেখানে বলা আছে, এই করোনার অধ্যায় যদি শেষ হয়েও যায়, এর রেশ থেকে যাবে বহুদিন। এই বিপর্যয়ের পরও আমরা যদি প্রকৃতির প্রতি আমাদের সর্বগ্রাসী চিন্তাধারায় পরিবর্তন না নিয়ে আসতে পারি, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। বলা যেতে পারে, এই সময়ে এসে আমরা একটা পরীক্ষা দিচ্ছি, এর ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। নিরাপদ একটি পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তাই প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই।

*লেখক: প্রকৌশলী, দক্ষিণ বাড্ডা, ঢাকা। [email protected]