ঢাকায় গাড়ি আর মানুষের ঢলে সুরক্ষা হাওয়া

কথা ছিল ঢাকায় সীমিত পর্যায়ে দোকানপাট খুলবে, নেওয়া হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা ব্যবস্থা। কিন্তু কার্যত কোনো কিছুই সীমিত থাকছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই। তদারকিও অনুপস্থিত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বৃদ্ধির প্রবণতার মধ্যেই ক্রেতা-বিক্রেতা, পথচারী ও যানবাহনের জট। গতকাল ঢাকার নবাবপুর রোডে।  ছবি: আশরাফুল আলম
কথা ছিল ঢাকায় সীমিত পর্যায়ে দোকানপাট খুলবে, নেওয়া হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা ব্যবস্থা। কিন্তু কার্যত কোনো কিছুই সীমিত থাকছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই। তদারকিও অনুপস্থিত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বৃদ্ধির প্রবণতার মধ্যেই ক্রেতা-বিক্রেতা, পথচারী ও যানবাহনের জট। গতকাল ঢাকার নবাবপুর রোডে। ছবি: আশরাফুল আলম

মার্চে সাধারণ ছুটির শুরুর দিকে ঢাকার যে চিত্র ছিল, এখন তার পুরোটাই উল্টো। কোনো সড়কই আর সুনসান নেই। যানবাহন চলছে নির্বিঘ্নে। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল ও সমাগম বেড়েছে। সব ধরনের দোকানপাট খুলেছে। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সুরক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

সব মিলিয়ে ঢাকায় এখন সবকিছুই শিথিল। অথচ রাজধানীতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইডিসিসিআর) ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত শনিবার পর্যন্ত ঢাকা শহরে মোট করোনা আক্রান্ত রোগী ছিলেন ৮ হাজার ৯২৩ জন, যা ওই দিন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৫৭ শতাংশ।

গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর থেকে শুরু করে কালশী হয়ে বনানী, গুলশান ১ ও ২ নম্বর, তেঁজগাও শিল্প এলাকা, মগবাজার, বেইলি রোড, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, কমলাপুর, মতিঝিল, শাহবাগ, হাতিরপুল, পান্থপথ, ধানমন্ডি, আগারগাঁও, তালতলা, শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকা ঘুরে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার শিথিলতার চিত্র দেখা যায়।

মোটরসাইকেলে এসব এলাকা ঘুরতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি মোড়ে দাঁড়াতে হয়েছে। কোথাও কোথাও যানবাহনের চাপ এত বেশি ছিল যে ট্রাফিক পুলিশকে সাধারণ সময়ের মতোই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুলিশের তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

ঢাকায় এখন শুধু বাস ও লেগুনা চলছে না, বাকি সবই চলছে। গলির পাশাপাশি প্রধান সড়কে নেমেছে বিপুলসংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা।

সিএনজিচালিত বৈধ-অবৈধ অটোরিকশা অহরহ চলাচল করছে। ব্যক্তিগত গাড়ি প্রচুর। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে। অ্যাম্বুলেন্সেও এখন যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে।

চলাচল একটু বেশি শিথিল হয়ে পড়ে ১০ মে থেকে, যেদিন পবিত্র ঈদুল ফিতরের কেনাকাটার সুযোগ দিতে সীমিতভাবে দোকানপাট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রথম দুই দিন মানুষের চলাচল ততটা বেশি ছিল না, যেটা দেখা গেছে গতকাল। সিএনজি অটোরিকশাচালক আবুল কালামও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘এখন তো সবাই চলাচল করতে পারছে। কেউ তো আগের মতো বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চায় না।’

এই শিথিলতা সরকারের নজরেও আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।

বেসরকারি অফিস খুলেছে

করোনা ঠেকাতে দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। এক মাস মোটামুটি সবকিছু বন্ধ ছিল। ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলতে শুরু করে। ৫ মে থেকে অন্যান্য কারখানাও খুলে যায়। সঙ্গে খুলতে শুরু করে ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যালয়।

>

মানুষ বাইরে, নির্বিঘ্নে চলে যানবাহন, বেসরকারি অফিস ও সব ধরনের দোকান খোলা, ফুটপাতে হকার। ঢাকার রূপ প্রায় স্বাভাবিক।

ঢাকার গুলশান এলাকায় গতকাল কথা হয় নাঈমুল ইসলাম নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। গুলশান ২ নম্বর সেকশনের মোড়ে নিজেদের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন তিনি। মুখে মাস্ক, হাতে পলিথিনের গ্লাভস বা দস্তানা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০ মে থেকে মোটামুটি পুরোদমে অফিস চলছে। শুধু বয়স্ক ও অসুস্থ কয়েকজনকে বাসা থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে।

নাঈমুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার আতঙ্ক থাকলেই কী, চাকরি বাঁচাতে হলে তো অফিসে আসতেই হবে।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার বিষয়টি জানালেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ। অফিস না খুলে উপায় ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসম্ভব বাসায় থেকে কাজ করার ব্যবস্থা নিতে বলছি।’

‘এ পেটের দায়’

মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে ফুটপাতে পোশাকের দোকান সাজিয়ে বসেছিলেন মো. আশরাফ। সাত দিন ধরে দোকান খুলছেন। দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হয়, লাভ হয় ৫০০ টাকার মতো। জানতে চাইলাম, যদি করোনা হয়? উত্তর দিলেন, ‘পেটের দায়ে পথে নামতেই হচ্ছে।’

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চায়ের দোকান ও ফুটপাতের খাবার হোটেল খুলেছে। সেখানে পাশাপাশি বসে খাবার খাওয়া, চা পান ও ধূমপান করেন রিকশা-অটোরিকশাচালক ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কালশী দিয়ে যাওয়ার পথে দেখা গেল, সন্তানসহ এক পরিবার রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে আছে। জানতে চাইলাম, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘরে না থেকে বাইরে কেন। নাসরিন বেগম উত্তর দিলেন, ‘এই গরমে বস্তির টিনের ঘরে থাকা যায় না।’

রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় প্রচুরসংখ্যক সাহায্যপ্রার্থী মানুষ। গাড়ি থামালেই তাঁরা দৌড়ে যান সাহায্যের আশায়। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় ভিড় বেশি। অনেকেই বয়স্ক। তাঁদের সুরক্ষাব্যবস্থা নেই, সে নিয়ে চিন্তাও নেই। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে ভিক্ষা করছিলেন আবুল খায়ের। বয়স ৬০ বছরের বেশি। বললেন, দুই ছেলেই ঢাকায় বাস চালাত। এখন বেকার। ভিক্ষা করে তিনি যা পান, সেখান থেকে এখন ছেলেদেরও কিছু দিতে হয়।

কেনাকাটায় বিধির তোয়াক্কা নেই

ঈদের কেনাকাটার জন্য ঢাকায় দোকানপাট খুলতে দেওয়ার আগে অন্তত ১৪টি নিয়মের কথা জানিয়ে দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বড় বিপণিবিতান, স্বনামধন্য ব্র্যান্ড ও অভিজাত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও এসব নিয়ম মানতে দেখা যায়নি।

জানতে চাওয়া হচ্ছে না যে ক্রেতার বসবাস দুই কিলোমিটারের মধ্যে কি না। কেউ পরিচয়পত্র দেখতে চাইছেন না। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফুটপাতে দোকান বসেছে। বড় দোকান ছাড়া কোথাও তাপমাত্রা মাপা হয় না। ছোট-বড় অনেক দোকানে জীবাণুনাশক রাখা হয়েছে নামকাওয়াস্তে। ক্রেতারা চাইলেই শুধু ছিটানো হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‌‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। শুধু পুলিশ নয়, সেনাবাহিনীও সাধারণ মানুষকে বারবার অনুরোধ করছে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হবেন না। কিন্তু তারপরও মানুষ বের হচ্ছে। সবাই বলছেন, তাঁরা নিজের জরুরি দরকারেই বের হচ্ছেন।’

এদিকে কয়েক দিনে ঢাকায় নতুন কয়েকটি বিপণিবিতান খুলেছে, যা ১০ মে খোলেনি। তালিকায় রয়েছে গুলশানের পুলিশ প্লাজা ও পল্টনের পলওয়েল মার্কেট।

ঢাকার কাঁচাবাজারে, ফলের দোকানে ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকের মুখেই মাস্ক থাকছে না। থাকে থুতনিতে। মুখে মাস্ক নেই কেন, জানতে চাইলে শেওড়াপাড়ার ফলের দোকানি সুমন মাতব্বর বলেন, গরমে সারা দিন মাস্ক পরে থাকা যায় না।

শিথিলতা কি বিপদ ডেকে আনছে

করোনা মহামারির বিস্তার রোধে দেশে দেশে আরোপ করা হয়েছে বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও লকডাউন (অবরুদ্ধ করা)। তবে যেসব দেশ লকডাউন শিথিল করার পথে হাঁটছে, তাদের তিনটি প্রশ্নের জবাব মেলানোর পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে, তা না হলে লকডাউন শিথিল করার পর আবার ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১১ মে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, শিথিল করার আগে মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না, সংক্রমণ বাড়লে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা বাড়তি চাপ নিতে সক্ষম কি না, রোগী ও তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে এবং সংক্রমণ বৃদ্ধি চিহ্নিত করতে সক্ষম কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশ তিনটি দিকের একটি দিক দিয়েও ভালো অবস্থানে নেই। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিথিলতার সুযোগ দেওয়া হয়েছে সংক্রমণ কমার পর। আমরা বাড়ার মধ্যেই শিথিলতার সুযোগ দিলাম। এর ফলে সামনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে।’