বাড়ছে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনা! কোভিড-১৯! কোয়ারেন্টিন! আইসোলেশন! লকডাউন!

শব্দগুলো যেন এখন কানের বিষ হয়ে উঠেছে। প্রায় দুই মাস ধরে একই কথা শুনতে শুনতে শরীর–মন সবই অস্থির হয়ে গেছে। একসময় মনে হয় কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দিই এক দৌড়। একটু আগের মতো বাইরের হাওয়া–বাতাস খেয়ে আসি, যা হবে দেখা যাবে। কিন্তু তক্ষুনি আবার মানুষের আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর শুনে মনে হয়, মৃত্যুদূত বুঝি ওই দরজায় নাড়া দিল।

বিশেষ করে গত কদিন যা দেখছি। মানে, বাংলাদেশেও যেভাবে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃত্যুর পরিসংখ্যান, তাতে কিছুটা ভয় মনে বাসা বাঁধাটা অস্বাভাবিক নয় বটে।

তবে যা–ই হোক, করোনার কারণে যে সবকিছু খারাপ হয়েছে, তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু ভালো কাজও কিন্তু হয়েছে। আমি কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ। মানুষের সঙ্গে মেশা, কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলা, এগুলো আমার বৈশিষ্ট্যের বিপরীতই বলা চলে। বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পরই যখন স্মার্টফোন পেলাম, তখন থেকেই প্রযুক্তির প্রতি নেশা ধরে গেল। একে একে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, সাইবার ওয়ার্ল্ড সবার সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে।

সারাক্ষণ এসব নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে অন্য কোনো দিকে কখনো নজর দেওয়া হয়নি। কেউ যদি বলত তোকে জেলখানায় আটকে রেখে দিলেও মনে হয় তোর কিছু হবে না। আমি বলতাম, একটা ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট কানেকশন দিলেই ব্যস, আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি যে ভুলে ছিলাম আর মানুষের সঙ্গে মেশার যে কি আনন্দ, সেটা এখন বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছি।

ঘটনায় ফেরা যাক, একটানা প্রায় এক মাস নিজের রুম থেকে বেরোয়নি। প্রথম দিকে তেমন কিছু মনে হয়নি। স্বাভাবিকই যাচ্ছিল সবকিছু, কিন্তু যখন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, তখন টনক নড়তে শুরু করল।

হিসাব করে দেখলাম, আগে দিনের বেশির ভাগ সময় কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতাম বটে। কিন্তু তারপরও দিনে কিছু সময়ের জন্য হলেও বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সময় কাটানো হতো। অপরিচিত কারও সঙ্গে সেভাবে কথা না হলেও কাজের সুবাদে অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে ঠিকই কথা হতো। তাদের সঙ্গে কাটানো যে সেই অল্প কিছুক্ষণও আমার স্বাভাবিক জীবনে বেশ ভালোই প্রভাব ফেলছে, সেটা এই সময়টা না এলে হয়তো কখনো বুঝতেই পারতাম না।

কোয়ারেন্টিনের সময় বেশ কিছু পরিবর্তনও এসেছে আমার মধ্যে। একটানা এত দিন ঘরে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাই সেদিন হঠাৎ করে দারোয়ান কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাকা ছাদ কি খোলা। হঠাৎ আমাকে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখে তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যে আনন্দিতও হলেন, তা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কথায় কথায় অনেক কিছু নিয়েই কথা হলো। অল্প কিছুক্ষণের কথাই যে মানুষকে এতটা আপন করে দিতে পারে, তা আমার জানা ছিল না।

যাহোক, শেষমেশ হ্যাঁ–সূচক উত্তর দিলেন বলে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে গেলাম। আমি যে বাসায় থাকি, সেখানে শিফট হয়েছি প্রায় দুই বছরের বেশি হবে। এই দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার ছাদে গেলাম সেদিন। এ তদিন পর ছাদ থেকে ঢাকা শহরকে দেখতে বেশ ভালোই লাগল। তা–ও আবার ফাঁকা ঢাকা। এ যেন এক বিরল চিত্র।

কিছু ছেলেকে দেখলাম ছাদের একপাশে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। অবাকই লাগল এটা দেখে যে ঢাকার ছেলেরাও ঘুড়ি ওড়াতে পারে! যাহোক, পরের দিনও ছাদে উঠতে গেলাম। সিঁড়িতে পাশের বাসার এক আন্টির সঙ্গে দেখা। যদিও এর আগে কখনো তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। দু–একবার কিছু কাজের জন্য আম্মুর সঙ্গে আমাদের বাসায় এসেছিলেন, তাই চেনা।

হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাও বাবা? যদিও হঠাৎ করে তাঁর প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তা–ও একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলাম, ভালো লাগছে না আন্টি, তাই একটু ছাদে যাচ্ছি। তিনি বললেন, তুমি তো কারও সঙ্গেই চলো না, কথা বলো না। মন ভালো না থাকলে আমাদের বাসায় তো চলে আসতে পারো। তোমার আপু আছে বাসায়, ওর সঙ্গে গিয়ে গল্প করলেও তো মন ভালো হয়ে যায়। তাঁদের আন্তরিকতা দেখে মনে হচ্ছিল একা একা থেকে কত কিছুই না যেন মিস করেছি আমি।

যত দিন এই বাড়িতে আছি, কোনোদিন তাঁদের সঙ্গে কথা বলিনি। তারপরও তাঁরা যেন আমাকে আপনের মতোই দেখেছেন, সেটা না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতাম না। বিল্ডিংয়ের আরও অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে গত কদিনে। একেকজনের একেক রকম চিন্তাভাবনা শুনে বেশ অবাক আর ভালোই লাগছে।

করোনাভাইরাস আর কিছু করুক আর না করুক, একটা কাজ ভালোভাবেই করেছে। আর সেটা হলো, মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে এনেছে। মানুষ একে অন্যের সঙ্গে এখন মন খুলে কথা বলছে। মা-বাবা ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প আড্ডায় মেতেছেন। এর থেকে সুন্দর চিত্র আর কী–ইবা হতে পারে। যেই চীন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় একে অপরকে কীভাবে হারাবে তা নিয়ে চিন্তা করত, তারা এখন একসঙ্গে মিলে কীভাবে এই বিপত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সেই চিন্তা করছে।

করোনার জন্য আরও একটা বিষয়েও পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। একদিকে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি যেমন কমেছে, তেমনি এর অসম ব্যবহারের পরিবর্তে ভালো দিকগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। কোয়ারেন্টিন বা লকডাউনের প্রথম দিকে যদিও মানুষ প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়, এমন দিকগুলোর ব্যবহার বাড়ছিল। আগের থেকে বেশি সময় মানুষ ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার শুরু করেছিল।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর একটানা ব্যবহারের পর এতেও তাদের একঘেয়েমি চলে এসেছে। ফলে এগুলোর বদলে এখন বাবা, মায়ের সঙ্গে সন্তানের সরাসরি ভাববিনিময় বাড়ছে। সারা দিন মুঠোফোনে না থেকে ছেলেমেয়েরা এখন তাদের মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করছে। একই সঙ্গে কমছে প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ইত্যাদি।

অন্যদিকে আসক্তির পরিবর্তে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারও কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে। যেমন শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনেই চালাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। অফিসের সব কাজ হচ্ছে অনলাইনে। বিশেষ করে করোনার এই বিপদকালে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কাজও অনেকটা সহজই হয়েছে বলা যায়। মানুষ এখন শুধু একটা কল করেই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে, তাদের পরামর্শ নিতে পারছে। আরও কত কী!

করোনাকালের এই জীবনগাথা যে জীবনের এক বিশেষ মুহূর্ত হিসেবে থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটাই আশা থাকবে, করোনার পরও যেন মানুষে মানুষে সম্প্রীতি এমনই থাকে।
[email protected]