দস্যুর কাছে হার মানবে সাদা পরি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

শেষ বিকেলের ক্লান্ত রোদে শ্রান্ত দাঁড়িয়ে আমি, নিশ্চুপ ভীত ঢাকার বুকে। আকাশের কাছাকাছি। ১০ তলা ভবনের ওপর। ওই যে তেজগাঁও রেলস্টেশন ধরে সর্পিল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ট্রেন। তখনো জানি না, এ ট্রেনের গতি আর কত দিন থাকবে। গতি শেষ হওয়ার আগেই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে নাকি।

সময়টা আরও দুই মাস আগের। মার্চের ২০ তারিখ। হাতে মাত্র ১০ দিন। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আসন্ন এইচএসসির জন্য। কিন্তু এ সময় আমার দৃষ্টি বাড়ির পানে। কারণ, পরীক্ষার চিন্তার ওপর আজ জাপটে ধরেছে এক দস্যুভীতি, অদেখা দস্যুর ভয়, করোনার ভয়।

১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর হোস্টেল থেকে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা যার যার মতো বাড়ির দিকে ছুটেছে। সময়ের দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ ভীতি গেড়ে বসেছে সবার মনে। তাই এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও অনেকে বই–খাতা কাঁধে বাড়িতে পাড়ি জমাচ্ছিল। হোস্টেল প্রায় ফাঁকা। দারুণ একাকিত্বে ভুগছি আমি। যে পূর্ব তেজতুরী বাজার কলেজ আর স্কুলের শিক্ষার্থীদের হইচইয়ে মুখর থাকত, সে এলাকার রাস্তাগুলো আজ নীরব। ভিড়–যানজট যার নিত্যদিনের সঙ্গী, সে আজ জনমানবশূন্য।

হোস্টেলের ছোট রুমের বিশাল জানালা গলিয়ে আমি যে বিশাল আকাশ, বিশাল বিশ্ব দেখি, তা আজ নির্বাক। আমার এ জানালা দিয়েই চোখে পড়ে আমার কলেজের শূন্য প্রাঙ্গণ, বাগানবিলাস ফুলগুলো ঝরে যাচ্ছে অঝোরে, এক সপ্তাহ আগেও যেখানে দেখতাম কত সাদা পরির আনাগোনা।

১৯ মার্চ অ্যাডমিট কার্ড দেওয়ার পর শিক্ষকেরা বলেছিলেন যে পরীক্ষা পেছানোর সম্ভাবনা আছে। একদিকে আতঙ্ক আর একাকিত্বের গ্রাস, অন্যদিকে আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি। এ টানাপোড়েনে ২২ মার্চ যখন পরীক্ষা পেছানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এল, তখন ব্যাগপত্র নিয়ে দে ছুট বাড়ির দিকে। স্বস্তি একটাই যে পরিবারের সঙ্গে থাকব। বাড়ি ফেরার পথে ফার্মেসিগুলোতে গিয়ে দেখি স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশের বড়ই অভাব। যা কিছু আছে তারও দাম চড়া। তিন গুণ দাম দিয়ে তা–ও একটি স্যানিটাইজার কিনতে হলো সুস্থতার বিবেচনায়।

আজ ১ মাস ২৬ দিন বাড়িতে এসেছি। কলেজের এই ২ বছরে ১৪ দিনের অধিক কোনো বড় ছুটি জোটেনি। তাই দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকতাম ছুটির জন্য। অথচ আজ এ সীমাহীন ছুটির পথে দাঁড়িয়ে আর কোনো দ্বারপ্রান্ত খুঁজে পাচ্ছি না। তবে মন্দের ভালো এই যে শৈশবের দিনগুলো যেন আবার খুঁজে পেয়েছি। খুব বেশি পড়ালেখা না হলেও পড়ালেখার সঙ্গে সম্পর্কটা মোটামুটি রেখেছি। আর কিছু বিনোদন ও শিক্ষামূলক কাজে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করছি এ আতঙ্কিত মনকে।

এ দীর্ঘ ছুটি আমার পারিবারিক বন্ধনকে করেছে আরও দৃঢ়। বাসায় এখন প্রায়ই ক্যারম টুর্নামেন্ট হয়। কখনো রেফারির কাজ করে ছোট ভাই। পিচ্চি রেফারির নানা রকম হাস্যকর ব্রিফিংয়ে খেলার মধ্যেই পেট ফেটে যায় হাসতে হাসতে। আবার কত রকম অদ্ভুত চিন্তা আসে মাথায়। সব ছুটিতেই হাটবাজারের ভিড়ে তো বাবাকে যেতেই হয়। তাই ভেবেছি, বাবার বেল্টে তিন ফুট লম্বা কতগুলো লাঠি লাগিয়ে দেব, যাতে নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করতে পারে। হা...হা...হা..., বাবা রাজি হলে অবশ্য বানিয়েই দিতাম। ইদানীং আমি দাবা খেলা শিখছি। ইউটিউব দেখে আবার স্কেচ প্র্যাকটিস শুরু করেছি। ড্যান ব্রাউনের ‘অরিজিন’ আর আর্থার কোনান ডয়েলের ‘শার্লক হোমস’ শেষ করলাম। সব মিলিয়ে ছুটিটা কেটেই যাচ্ছে।

তবে দিন শেষে খবরের চ্যানেলগুলো ছাড়তেই আবার সেই ভয়। হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা। পুরো বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনা রোগী। আর এক বেলা খাদ্যের আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে যাঁরা, তাঁদের দেখেই বুকটা কেঁপে ওঠে। কবে শেষ হবে এ দস্যুর দস্যিপনা? আবার কবে ফিরে যাব স্বাভাবিক জীবনে? ফিরতে পারব তো? কলেজ প্রাঙ্গণে যত সাদা পরির আনাগোনা দেখতাম, ছুটির পরও এদের সবাইকে দেখব তো? নাকি দস্যুর কাছে হার মানবে কোনো পরি!

*লেখক এইচএসসি পরীক্ষার্থী, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা। [email protected]