সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্নের কথা কে না বলতে চায়, কে না জানাতে চায় সবাইকে। হ্যাঁ, জানিয়ে দিতে চাইছি স্বপ্নের কথা। জানুক সবাই স্বপ্নের কথা, জানুক সবাই আশাবাদের কথা। ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষণে বলেছিলেন, আমার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন, জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে, সাবেক দাসের সন্তান আর সাবেক দাস-মালিকের সন্তান একসঙ্গে বসতে সক্ষম হবে ভ্রাতৃত্বের আসনে।

মার্টিন লুথার কিং আরও স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমার একটি স্বপ্ন আছে যে আমার ছোট চারটি সন্তান একদিন এমন একটি জাতির মধ্যে বসবাস করবে, যেখানে গাত্রবর্ণ দিয়ে আর তাদের বিচার করা হবে না, করা হবে চরিত্রগুণ দিয়ে। আজ একটু ভিন্ন ফ্রেমে যদি মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো স্বপ্ন দেখি আর স্বপ্নের সত্যতার প্রত্যাশা রাখি। ভয় নেই আলো আসবেই।

পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি ছাড়া সুন্দর এক পৃথিবী ভাবাই যায় না। ঈদের শপিং প্রসঙ্গে যদি বলি, এবার ঈদে শপিংয়ের কথা না ভেবে না খাওয়া মানুষের কথা ভাবুন। পুরো প্রোগ্রামটা বদলে দিলে কেমন হয়। নির্ধারিত অর্থ বিলিয়ে যদি দিই অনাহারির তরে। তাহলে বেশ ভালো হবে মনুষ্য জাতির। এবার ঈদ এসেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন বাস্তবতায়, দেশ পার করছে সংকটকাল। এ পরিস্থিতিতে আমাদের শপিং না করে এর অর্থ অসহায়, দরিদ্র কর্মহীন জনগণের মাঝে বণ্টনের যদি স্বপ্ন দেখি।

অধিকাংশ বাসায় গৃহকর্মী নিয়োজিত আছে। মাঝে মাঝে গৃহকর্মী নির্যাতিত হওয়ার খবর দেখি। এবার যদি ঠিক বিপরীত খবরের স্বপ্ন দেখি। আর কদিন পর ঈদুল ফিতরের শুভাগমন হবে। চলছে রমজানুল মোবারক মাস। সিয়াম সাধনার মাস। রোজা আমাদের প্রেমপ্রীতির চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। করোনা সংকটে গৃহকর্মীকে পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ছুটি দিয়েছেন অথবা আসতে বারণ করেছেন। গৃহকর্মী কাজ করে এই মাইনে দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। এই দিনগুলোতে আপনার গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত বলে লজ্জা করে মাইনে না চাইতে পারেন অথবা নিজের বেখেয়ালে যদি বাদ পড়ে (একটু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এই প্রয়াস), তাহলে কষ্ট পাবে মানুষ, কষ্ট পাবে মানবজাতি। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। চলুন, আমরা নিজে তাঁদের পাশে দাঁড়াই এবং অন্যকেও উৎসাহিত করি। খেয়াল করে পরিশোধ করি মাইনেটা। ঈদের আনন্দও তাঁদের পরিবারে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন রাজধানীসহ সব শহরে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষ। মহামারির সময় দুই মাস বা তিন মাস অথবা নিতান্ত এক মাসের বাড়িভাড়া মওকুফ করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ রাখছি। চাকরি ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। পরিবারকে খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত টাকাও নেই অনেকের কাছে। পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষণ না থাকায় জীবন-জীবিকার বিষয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। লকডাউনের সময় কাজ হারানো নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বিশেষ করে রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, দিনমজুর, হকার, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন দোকান, মার্কেটের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মহামারির সময় আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাসাভাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেশের মানুষ বেশ উপকৃত হবে। বাড়িওয়ালাদের প্রতি অনুরোধ করছি, বিষয়টি আমলে নেবেন। স্বপ্নের দেশ গঠনে শামিল হন সবাই। সেই স্বপ্ন দেখছি।

একটু খাবারের কথা ভাবি। এই সময়ে খাবার বিলিয়ে দিতে পারি সামর্থ্যবানেরা। খাবার বিলিয়ে দেওয়ার এক মোক্ষম সুযোগ মনে করছি। ইসলামে অভুক্তকে খাবার খাওয়ানো সীমাহীন পুণ্যের কাজ। চলুন আমরা সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী অভুক্তদের পাশে দাঁড়াই। রোজা আমাদের মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক। রোজা পালনের মাধ্যমে ধনীরা গরিবের দুঃখ বোঝে, ক্ষুধা-পিপাসার জ্বালা অনুভব করে। বুঝতে পারে অসহায় নিরন্ন মানুষের ও খাদ্যের সম্মান। মর্যাদা দিতে শেখে ক্ষুধাকে ও ক্ষুধার্ত মানুষকে। উপলব্ধি করে, কেন অন্নহীন গরিব মানুষ একমুঠো খাবারের জন্য অন্যের ঘরে কাজ করে। অনুধাবন করে দুস্থ গরিব লোকেরা ধনী হওয়ার লোভে নয়, সম্পদের নেশায় নয়, ভোগ-বিলাসের মোহে নয়, শুধুই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবার অগোচরে দৃষ্টির আড়াল হলে সামান্য বাসি খাবারের প্রতি হাত বাড়ায়। কেন গরিব মা তাঁকে খেতে দিলে নিজে না খেয়ে আঁচলে বেঁধে নেন তাঁর অভুক্ত সন্তানের জন্য। অনুভব করে ক্ষুধায় কাতর মানুষ কেন তার আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়, মর্যাদা ভুলে যায়, মান-ইজ্জত বিকিয়ে দেয় খাবারের জন্য। তাদের ঘৃণা ও উপেক্ষা নয়, তাদের জন্য ভালোবাসা ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। খাবার বিলিয়ে দিতে হবে আমাদের। সেই স্বপ্ন দেখি।

করোনা সংকট সবাই মিলে কেটে উঠতে হবে আমাদের। পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি ছাড়া করোনা মোকাবিলা করা অসম্ভব। আজ শুভকামনা করি সবার জন্য। সবার মধ্যে নতুন অনুভূতি হোক ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। এ সংকট কাটতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবী অনেক সুন্দর হবে।

‘আনন্দরূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশা ও আনন্দ জাগিয়ে রাখতে বলেছেন। বলেছেন, ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে, ক্ষুদ্র অহমিকা দূর করে নিজের অন্তঃকরণকে একবার জাগিয়ে তুলতে। বলেছেন, ‘নিজের এই ক্ষুদ্র চোখের দীপ্তিটুকু যদি আমরা নষ্ট করিয়া ফেলি, তবে আকাশভরা আলো তো আর দেখিতে পারবো না।’

আমরা আকাশ ভরা আলো দেখতে চাই। শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবুর মতোই এই আশাবাদ বুকে ধরে রাখি। ‘ভোর হয়নি, আজ হলো না, কাল হবে কি না, তা-ও জানা নেই, পরশু ভোর ঠিক আসবেই’। আমরা সুন্দর এক পৃথিবী দেখব।

*লেখক: প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। [email protected]