ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন: করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর কাজ কম

শর্ত সাপেক্ষে খোলা বিপণিবিতানে, এমনকি স্থানান্তরিত কাঁচাবাজারগুলোতেও রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। জীবাণুনাশক যাওবা ছিটাচ্ছে, কাজটার যুক্তিযুক্ততা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। করপোরেশন অনুমোদিত কয়েক হাজার বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই প্রতিদিন সব বাসাবাড়ির আবর্জনা সরাচ্ছেন।

অথচ দেশে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৬০ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে রাজধানীতে। ঢাকা মহানগরে দুই সিটি করপোরেশনের আরও একটি সার্বিক দায়িত্ব ছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে নাগরিকদের সচেতন করা। রাজধানীতে করোনাদুর্গত মানুষদের সরকারি ত্রাণ পৌঁছানোর দায়িত্বও করপোরেশনের। এরই মধ্যে এসে পড়েছে ডেঙ্গুর মৌসুম।

দুই করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের কর্মীরা যথাসাধ্য কাজ করছেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে সাধারণ ছুটির আগেই তাঁরা দুটি জনসচেতনামূলক প্রচারপত্র বিলিয়েছেন। কাঁচাবাজার সরিয়েছেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সঙ্গনিরোধে রাখতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করেছেন, ত্রাণ বিতরণ করছেন।

তবে নগরবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনগুলোর সচেতনতামূলক কাজ চোখে পড়ার মতো নয়। ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের অভাব ছিল। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মহামারি পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে জনসচেতনতা তৈরি এবং বাজার তদারকিসহ নানা কাজে আরও সক্রিয় হতে পারতেন।

গত রোববার পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতে করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৫৬৫ জন। সবচেয়ে বেশি রোগী দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ীতে। শতাধিক ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন দক্ষিণের বাবুবাজার, কাকরাইল, রাজারবাগ ও লালবাগ এবং উত্তরের মহাখালী, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরায়।

বিপণিবিতানে, কাঁচাবাজারে বেসামাল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চলার শর্তে গত ১০ মে থেকে বিপণিবিতানগুলো খুলে দিয়েছে সরকার। তদারকির দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ঢাকায় মোট সোয়া ৫ লাখের মতো দোকান রয়েছে। একক তদারকির মতো লোকবল-সামর্থ্য সিটি করপোরেশনের নেই।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার গত রোববার বিকেলে (সন্ধ্যায় চাকরিচ্যুত) প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেশন দোকানমালিক সমিতিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সরাসরি তদারকি বিষয়টি দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দক্ষিণের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন অবশ্য বললেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাজার ঘুরছেন, জরিমানা করছেন।

দুই করপোরেশন এলাকায় কাঁচাবাজার আছে ২৮টি। সংক্রমণ বিস্তারের বিশেষ ঝুঁকির মুখে করপোরেশন ২৪টিকে খোলা জায়গায় সরায়। কিন্তু কাজটা শুরুই হয় এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে। স্থানান্তরিত বাজারগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করতে করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ মালিক সমিতিগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে, অন্যদের সমন্বয় করছে তবে কারও এগিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকছে না।

জীবাণুনাশক ও অন্যান্য

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আটটি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি গাড়ি প্রধান সড়কগুলোয় জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা বেহুদা, বরং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে৷

উত্তরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমদাদুল হক বললেন, তাঁরা ১০টি অঞ্চলে পথচারীদের হাত ধোয়ার জন্য ১০০টির মতো বেসিন বসিয়েছেন। তবে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার মিরপুর ১ নম্বর ও শ্যামলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানকার বেসিন নোংরা। মিরপুর ১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের বেসিনটি সিটি করপোরেশনের বিশাল এক সাইনবোর্ডের আড়ালে ঢাকা। সাবানও নেই।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী নেই

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা বলছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের উপযুক্ত সরঞ্জাম ও নির্দিষ্ট পোশাক ব্যবহার করতে হবে। কাজের পর সেগুলো জীবাণুমুক্ত করতে হবে। আবর্জনার মধ্যে কোনো মাস্ক থাকলে সেটা হাত দিয়ে ধরা যাবে না।

করপোরেশন নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী দিয়েছিল, যদিও সেগুলোর অধিকাংশই ছিল একবার ব্যবহারের উপযোগী। এদিকে ঢাকার দুই সিটিতে বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিন বর্জ্য সংগ্রহ করেন সাড়ে আট হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁরা কাজ করেন সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে।

করপোরেশন তাঁদের সুরক্ষাসামগ্রী বা জীবাণুনাশক দেয়নি। তাঁরা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন, সর্বত্র ঝুঁকি ছড়াচ্ছেনও। গত ২৭ এপ্রিল বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মিরপুরে সুরক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীদের এসব দিতে বলেছেন। সবাই দিচ্ছে না।

অপ্রতুল ত্রাণের সমন্বয়হীন বিতরণ

চলমান টানা লকডাউনে রাজধানীর কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তা দিচ্ছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় এটা বিতরণ করছে দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু কেউ একেবারেই কিছু পাচ্ছেন না, কেউ একাধিকবার পাচ্ছেন।

পরিবারপ্রতি একবার পাঁচ কেজি চাল আর দুই কেজি আলু বরাদ্দ। আবার বরাদ্দ কম থাকায় অনেকে বাদ পড়ছেন। দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল, মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ আর কাউন্সিলরদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ–যাবৎ মোট ৪ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অথচ দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে কমবেশি ১০ থেকে ১২ হাজার পরিবারের ত্রাণ দরকার।

করোনার দরজায় ডেঙ্গুর কড়া নাড়া

ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুর আগে মার্চ-এপ্রিল মাসে যেসব প্রতিরোধী কাজ করার কথা, সেগুলোর অধিকাংশই হয়নি। মে মাসের গোড়ায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে মাঠে নেমেছে দুই সিটি করপোরেশন। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত আছে। পর্যায়ক্রমে ওয়ার্ডগুলোতে লার্ভা মারার এবং উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

গত শনিবার থেকে মশক নিধনে ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু করেছে উত্তরের করপোরেশন। বাড়ি, স্থাপনা, নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে সতর্ক করা হচ্ছে। এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে।

তবে উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান বলছেন, এবার এলাকাভিত্তিক ডেঙ্গুর সচেতনতামূলক কার্যক্রম সীমিত আকারে করা হবে। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, করোনা প্রতিরোধেও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ পর্যাপ্ত কি না বলা মুশকিল। সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।