বদলে যাওয়া ব্যস্ত জীবন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

১৬ মার্চে খবর পেলাম কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। সেখানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় আলিম প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করি। খুব একটা খুশি হতে পারিনি খবরটি শুনে। ২৫ মার্চ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। সেটি স্থগিত হয়ে গেল। তাই অনিচ্ছাকৃত বাড়ি যাওয়া।

কখনো ভাবিনি বাংলাদেশের মতো একটা দেশে বেশিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সে জন্য খুব বেশি জামা–কাপড় সঙ্গে নিইনি। ভেবেছিলাম সপ্তাহ বা ১০ দিন থেকে আবার চলে আসব। অল্প কাপড় ও বই নিয়ে রওনা হলাম বাড়ির পথে হবিগঞ্জে। বাড়ি যাওয়ার পর বেশ আরামেই ছিলাম কয়েক দিন। তারপর হঠাৎ শুরু হলো সাধারণ ছুটি। বাস, ট্রেন, দোকানপাট সবকিছু বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। আমার চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়াও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। শুরু হলো এক নতুন জীবন। লকডাউন জীবন।

ও হ্যাঁ! বলে রাখি, আমি একজন খুদে সংগঠকও বটে। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছি। হবিগঞ্জ ফিরেই শুরু করেছিলাম কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমার ক্ষুদ্র লড়াই। জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, বাজার এলাকায় পরিচ্ছন্নতার জন্য হাত ধোয়ার অস্থায়ী বেসিন স্থাপন, রাস্তার ভাসমান মানুষদের এক বেলা খাবার, ইফতার বিতরণ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের যাঁরা চক্ষুলজ্জায় হাত পাততে পারেন না, সমাজের বিত্তশালী মানুষদের কাছে তাঁদের ভালোবাসার উপহার প্রদানসহ নানা কর্মকাণ্ডে। এসব নিজ উদ্যোগে নয়, আমার ক্ষুদ্র সংগঠনের পক্ষে আঞ্জাম দিয়েছি। তবে সময়ের পালাবদলে এ কাজগুলোও ধীরে ধীরে থেমে গেল।

চট্টগ্রামে ছিল আমার ব্যস্ত জীবন। ভোর ছয়টার সময় উঠতে হতো ঘুম থেকে। আলসে চোখে ছুটতে হতো প্রাইভেটে। একের পর এক থাকত প্রাইভেট, কোচিং, মাদ্রাসার ক্লাস। শেষ হতো বিকেল চারটায়। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরতাম প্রতিদিন। বিকেলবেলা উপভোগ করতাম কেবল শুক্রবার। সন্ধ্যা থেকে আবার শুরু হতো পড়াশোনা। আমি ব্যাচেলর বাসায় থাকতাম। তাই রাতের খাবারের জন্যও রান্নার কাজ করতে হতো। সবকিছু শেষে অবসর হতাম রাত ১১টা নাগাদ। ঘণ্টাখানেক ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রাউজ করে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম পরবর্তী দিনের অপেক্ষায়। কেবল শুক্রবারটাই ছিল আমার জন্য অনিয়ম। এই একদিনই ভুলিয়ে দিতে সাহায্য করত পুরো সপ্তাহের ক্লান্তিগুলো। এভাবেই রুটিনমাফিক চলছিল আমার জীবন।

লকডাউনে আমার সবচেয়ে বড় যে সমস্যা শুরু হয়েছিল তা ছিল, ঘুমের সমস্যা। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো অদৃশ্য কারণে আমার রাতের ঘুম হারিয়ে গিয়েছে। এখনো তাই। কিছুতেই ঘুম আসে না রাতে। এমনকি সূর্য উদয়ের অনেক পরেও চোখ জুড়াত না ঘুমে। অবসর এই সময়টা কাটাতাম বই পড়ে। শেষ রাতে উঠে পড়তাম তাহাজ্জুদের নামাজ এবং কোরআন তিলাওয়াত। ফজরের নামাজ পড়ে আবার বই পড়া শুরু হতো আমার। চলত ঘুমে চোখ জুড়ানো পর্যন্ত। অনেক দিন টানা ৩০ ঘণ্টাও না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। নিজের পড়াশোনা করতাম মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা। চলে এল পবিত্র রমজান মাস। এ মাসেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি দৈনন্দিন জীবনে। এভাবেই পার করছি অনির্দিষ্ট অবসর সময়। জানি না কতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে করোনাভাইরাসের সঙ্গে। কবে দেশ মুক্ত হবে অদৃশ্য এই শত্রুর হাত থেকে। কবে মানুষ ফিরে পাবে তাদের হারানো সেই ব্যস্ত জনজীবন। সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছি প্রতিদিন।