সামাজিক নিরাপত্তা খাত হোক ডিজিটাল

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব সহায়তা দেওয়া হয়, তার বড় অংশই ত্রুটিপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই যাদের সহায়তা পাওয়ার দরকার নেই তারা পায়, আবার যাদের দরকার, তাদের কাছে তা যায় না। এমন বাস্তবতায় হাতে হাতে সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে গোটা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এবং প্রথম আলো আয়োজিত ‘ডিজিটাল লেনদেনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রসার ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর কারিগরি সহায়তায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সব কর্মসূচিই ডিজিটাল হোক
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মহীনতা ইত্যাদির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে কোভিড। বিশেষ করে দু-চার দিন কাজে না গেলে যাদের সংসারই চলে না, তারা খুবই বিপদে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে আড়াই হাজার টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারে যে টাকাটা দেওয়া হচ্ছে, এখন তো মনে হচ্ছে পুরো সামাজিক নিরাপত্তা খাতই ডিজিটাল হওয়া উচিত। এটা এখন অনিবার্য প্রক্রিয়া। মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমাদের তথ্যভান্ডার দুর্বল। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি পরিচয়পত্র এখনো তৈরি হয়নি। আমরা যথাযথ তথ্যের সহযোগিতা নিতে পারছি না।’

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ূমের সূচনা বক্তব্যের পর এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কোভিডের আঘাত আসার আগেই দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি। ১২০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাজেট ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আড়াই শতাংশের কম। কিন্তু উপকারভোগীদের সঠিকভাবে শনাক্ত করা একটা চ্যালেঞ্জের কাজ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপের তথ্য ব্যবহার করে দেখা গেছে, ৭১ শতাংশ যোগ্য ব্যক্তি নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাইরে রয়েছে। যারা বেষ্টনীর মধ্যে আছে, তাদের ৪৭ শতাংশেরই সাহায্য পাওয়া উচিত নয়।

কোভিডের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়ে ৪ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি পর্যন্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, তাদের মধ্যে এক থেকে দেড় কোটি মানুষের সাহায্য পাওয়া দরকার। তিন মাসের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ দরিদ্রকে সরাসরি মাসে ৩ হাজার করে টাকা দিলে ব্যয় হবে ১১ হাজার কোটি টাকার মতো এবং এ ব্যয়টা যৌক্তিক হবে।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার ৫০ লাখ পরিবারে আড়াই হাজার টাকা নগদ পাঠানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, এতে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? এক নম্বরে অনেক নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে নাম না মেলা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যাচ্ছে।’ তিনি প্রত্যেক গ্রামে উপকারভোগীদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা মোবাইল হিসাব থাকা ভালো। কিন্তু না থাকলেই সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি তা পাবেন না, এটা ঠিক নয়। ভয় হচ্ছে, এনআইডি বা হিসাব না থাকার কারণে না কেউ বাদ পড়ে যায়। তবে হিসাব খোলার কাজটিও পাশাপাশি শুরু হতে পারে। উপকারভোগী নির্বাচনটা যেমন দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে, তাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকটিও দেখতে হবে।

বিকাশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল কাদির বলেন, ডিজিটাল তথ্য ব্যবহার করে উপকারভোগী নির্বাচন করলে যত দূর সম্ভব তা যথাযথ হবে। এরপরও ৪ থেকে ৫ শতাংশ ভুল থেকে যেতে পারে।

ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরীন বলেন, শুধু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) নয়, ব্যাংক হিসাব এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও বেতন-মজুরি দেওয়া হচ্ছে। সরকার যে ৫ হাজার কোটি টাকা দিতে বলেছে, ব্যাংক হিসাব বা এমএফএসের মাধ্যমে, তাতে অনেক হিসাব বেড়েছে। এই নীতিসহায়তার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। আবার ৫০ লাখ পরিবারকে এমএফএসের মাধ্যমে দেওয়ার কথা বলার কারণেই কিন্তু অনেক কিছু ধরা পড়েছে।

সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের ডিজিটাল অর্থনৈতিক সেবার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তহুরুল হাসান বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়ার উদ্যোগ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়ের সম্মানীয় ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, গ্রাহক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং গ্রাহকদের পছন্দের স্বাধীনতাও থাকতে হবে।