আইলা দিয়ে আম্পানকে মাপছে মানুষ

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা উপকূলে উত্তাল হয়ে উঠেছে নদ-নদীগুলো। সাতক্ষীরায় দুপুর থেকে বৃষ্টি আর মৃদু বাতাস। জোয়ারের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষের উদ্বেগও। উদ্বেগের বড় কারণ নাজুক হয়ে পড়া বাঁধগুলো।

 ১১ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে পারেনি এই বাঁধগুলো। বাঁধ ভেঙে লোনা পানি ঢুকে পড়ে ফসল ও প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি করে যায়, যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি এ এলাকার মানুষ। কৃষিজমিগুলো এখনো আবাদযোগ্য হয়নি। খাবার পানির তীব্র সংকট। এর মধ্যেই আসছে আরেক ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে আম্পান আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর চেয়ে শক্তিশালী। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও হব বেশি। এর সঙ্গে আছে করোনার আতঙ্ক, নিজেকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা।

এসব খবরে ঘুম নেই পোড়–খাওয়া মানুষগুলোর চোখে। সাতক্ষীরার অনেক এলাকার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠে গেছেন।

 এদিকে খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, বুধবার বিকেলের দিকে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে সেটি আঘাত হানতে পারে। ঝড়টি ইতিমধ্যে সিডরের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ঝড়ের প্রভাবে নদীতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জলোচ্ছ্বাসের এসব খবরে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিয়ে আতঙ্ক বেড়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির অন্তত ১৩টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যা মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ডাম্পিং করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। খুলনার কয়রা উপজেলার ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নিয়েও উদ্বেগে মানুষ।

 এসব নানা শঙ্কায় সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত এলাকার কিছু মানুষ আগেভাগেই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুরসহ অন্যান্য ইউনিয়নের সাধারণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার কাজ শুরু হয়েছে গতকাল সকাল থেকে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কাজ করছেন। জেলার ১ হাজার ২৭২টি আশ্রয়কেন্দ্র ইতিমধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কঠিন

 গাবুরার চাঁদনীমুখা সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া আকলিমা বেগম জানান, তাঁরা এক কক্ষে ২০ জনের মতো অবস্থান করছেন। সেখানে অনেকে মাস্ক ব্যবহার করলেও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার কোনো সুযোগ নেই।

 প্রায় একই কথা বলেন চুনকুড়ি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া অজিত সরদার। ৮০ বছরের ওই বৃদ্ধ জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল দিনের বেলা মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু রাতের মধ্যে প্রায় সব পরিবারের লোকজন চলে আসবে। তখন সামাজিক দূরত্ব রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর গাবুরা সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া শিলা খাতুন জানান, তাঁর কক্ষে যাঁরা অস্থান নিয়েছেন অধিকাংশেরই মুখের মাস্ক নেই। তবে চেয়ারম্যান কাউকে কাউকে মাস্ক দিয়েছেন।

 এদিকে শ্যামনগরের ইয়ুথ ক্লাবের সভাপতি ইমরান হোসেন জানান, করোনার কারণে সবারই ঝুঁকি বেড়েছে। তাঁরাও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

 গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই সাতক্ষীরার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও আবহাওয়া ছিল গুমোট। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শুরু হয় বৃষ্টি আর মৃদু বাতাস।

 শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম আবুজর গিফারী জানান, ‘উপকূলে ইতিমধ্যে ঝোড়ো বাতাসসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা থেকে ১০ হাজার মানুষকে নিরাপদে আনার কাজ চলছে। এ জন্য ৫০টি বাস ও ১০০ ট্রলার রেডি করা হয়েছে। সকাল থেকে কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।

 তিনি জানান, সন্ধ্যার আগেই গাবুরায় ১৫ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে। এ ছাড়া বাকি মানুষ ইতিমধ্যে আত্মীয়স্বজনসহ নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যানকে যাঁদের মাস্ক নেই তাঁদের পৌঁছে দিতে বলার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বলা হয়েছে।

খুলনার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও ফাঁকা

 ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবিলায় খুলনা জেলা প্রশাসন ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে। করোনার মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও এক কেন্দ্রে অধিক মানুষের সমাগম কমাতে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে চলছে মাইকিংও। এ ছাড়া জেলা-উপজেলায় পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তবে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কোনো মানুষই আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।

 খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। করোনার মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে। খাদ্যসামগ্রীও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে। ঝড়ের সংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।

 জানতে চাইলে খুলনার দাকোপের বানীশান্তা পিনাকপাণি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং ওই ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সঞ্জীব কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে গতকাল রাতে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। মাইকিং হয়েছে। লোকজন এখনো আসেনি। তবে খাবার তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা চালানো হবে। সাবান–পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মাস্ক পরে আসার জন্য বলা হয়েছে। যদি কারও না থাকে তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সামাজিক দূরত্ব মানানোর চেষ্টা করা হবে। একটা পরিবারকে এক জায়গায় রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা সচেষ্ট থাকবেন। দেখা যাক কী হয়।