সরেজমিন শ্যামনগর: 'বাড়ি ছাড়তে কতেছাও, তাতে আমাগো আরও ক্ষতি হবে'

মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ম্বেচ্ছাসেবীদের মাইকিং। গতকাল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে। ছবি: প্রথম আলো
মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ম্বেচ্ছাসেবীদের মাইকিং। গতকাল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে। ছবি: প্রথম আলো

৮০ বছরের বৃদ্ধ রুস্তুপ তরফদার। ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৯ সালের বুলবুলসহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই রুস্তুপ তরফদার বলছিলেন, ‘ঝড়ের সঙ্গে আমাদের লড়াই করা অভ্যেস আছে। তুমারা বাপু কেন গো বারবার বাড়ি ছাড়তে কতেছাও। তাতে আমাগো আরও ক্ষতি হবে। বাড়িতেই থাকব।’

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ডুমুরিয়া খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন রুস্তুপ। ঘূর্ণিঝড় আম্পান নিয়ে সুন্দরবনঘেঁষা শ্যামনগর উপজেলার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও বেশির ভাগ মানুষ ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না। তাঁদের অনেকের ধারণা, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি, এবারও হবে না। গতকাল সুন্দরবনসংলগ্ন গাবুরা ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

গতকাল বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ারের পানি বেড়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় ফুট মতো। লাল পতাকা পতপত করে উড়ে জানান দিচ্ছে ঝড়ের আগাম সংকেত। গাবুরা ইউনিয়নে মাইকিং করে মানুষকে বিশেষ করে বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে শ্যামনগর সদরে যেতে বলা হচ্ছে। নদীর মুন্সিগঞ্জ পারে অপেক্ষা করছে মানুষ বহন করার জন্য ৪০-৪৫টি যাত্রীবাহী বাস। গাবুরার পাড়ে ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিটিতে কিছু মানুষ উঠেছে। মানুষ পার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য খোলপেটুয়া নদীর ডুমুরিয়া খেয়াঘাটের পাশে অপেক্ষা করছে বিজিবি, পুলিশ, বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, নেভির ২৫-৩০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্রলার। কিন্তু সন্ধ্যার পর এসব নৌকা ও ট্রলার মানুষ ছাড়া ফিরে যায় নীলডুমুরের পারে।

ঘাটে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মরবে, তাও কেউ বাড়ি ছেড়ে বের হতে চায় না। বুধবার ভোরে আবার ড্রাইভ দিয়ে চেষ্টা করব মানুষদের নিরাপদ শ্যামনগর উপজেলা সদরে নিয়ে যেতে।’

শ্যামনগরের সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ এলাকার অসীম কুমার মণ্ডল দুপুরে প্রথম আলোকে জানান, দুপুর ১২টা থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার পর এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এলাকায় এলাকায় মাইকিং চলছে মানুষজনকে নিরাপদে চলে যেতে। সুন্দরবনের ভেতর মৌয়ালি ও নদীতে মাছ ধরার জেলেদেরও মাইকিং করে লোকালয়ে ফিরে আসার জন্য বলা হয়েছে।

গাবুরার ৯ নম্বর সোরা গ্রামের ৭০ বছরের ইউনুস শেখ বলেন, ‘মরণ হলি বাড়িতে হোক। কুরানার কারণে বাড়ি থ্যাকি বের হই না। এখন কেন গো অন্যখানে যাবো।’

নীলডুমুর খেয়াঘাটে স্বেচ্ছাসেবক রণি ও আল মামুন গাবুরা এলাকা থেকে পার হয়ে আসা মানুষদের সহযোগিতা করে বাসে তুলে দিচ্ছেন। সারা দিনে ৩০০-৪০০ মানুষ গাবুরা থেকে শ্যামনগর সদরে পার হয়েছে বলে জানান তাঁরা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে তাঁরা বলেন, করোনার শুরু থেকে তাঁরা এভাবে কাজ করে চলেছেন। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও ঠিক থাকছে না।

ডুমুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারসহ এসে উঠেছেন আকলিমা খাতুন। তিনি জানান, চেয়ারম্যান ও পুলিশ এসে বলে গেছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। কিন্তু অল্প জায়গায় মানা যাচ্ছে না।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, শ্যামনগরে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮০০ মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছে। গাবুরা থেকে পাঁচ শতাধিক মানুষকে শ্যামনগর নিয়ে আসা হয়েছে। আজ বুধবার সকাল থেকে আবার নিয়ে আসা হবে।