সুষমার চোখে মহামারির একাল-সেকাল

সিলেটের লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ একজীবনে দেখেছেন বেশ কয়েকটি মহামারি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সিলেটের লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ একজীবনে দেখেছেন বেশ কয়েকটি মহামারি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সিলেটের লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশের বয়স ৯০ পার হলো ১ মে। দীর্ঘজীবনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগ–ব্যাধির অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সুষমা দাশ বাংলা লোকসংগীতের এক কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। ২০১৭ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামে। ১৯৮৮ সালে স্বামীর সঙ্গে সপরিবারে চলে আসেন সিলেট শহরে। এখন নগরের হাওলদারপাড়া এলাকায় তাঁর বাস। সেখানে বসেই শোনালেন তাঁর শৈশব স্মৃতিতে থাকা নানা অসুখের কথা।

সুষমা বললেন, 'বয়স যখন ৪ বছর, তখন বানিয়াচংয়ে 'লাল জ্বর' ছড়িয়ে পড়েছিল। 'লাল জ্বর' মানেই ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। বৈদ্য নাই, পথ্য নাই। কী যে চিন্তা! তখন 'লাল জ্বর' তাড়াতে ছেলেরা ডান হাতে আর মেয়েরা বাম হাতে কবজির উপরে লাল সুতা বেঁধে রাখতেন। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। তবে কেউ একজন হয়তো এ রকম প্রচার করেছিলেন। তাই মনের ভয়ে গ্রামের পর গ্রামের মানুষজন হাতে লাল সুতা বাঁধতে শুরু করলেন!'

১১ বছর বয়সে সুষমা দাশ তাঁর আশপাশের গ্রামগুলোতে কলেরা ও বসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়তে দেখেন বলেন জানালেন। তিনি বলেন, 'সেই ছোটবেলায় লাল জ্বর, কলেরা আর বসন্ত রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। কে কখন আক্রান্ত হন, তা নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। সেসব রোগেরও চিকিৎসা বেরিয়েছে। করোনাভাইরাসের চিকিৎসাও নিশ্চয়ই বের হবে। তবে মাঝখান থেকে সেই ছোটবেলার দিনগুলোর মতো কত প্রাণ চলে যাচ্ছে।' তিনি আতঙ্কিত না হয়ে মনে সাহস রাখতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'এ দুঃসময় কাটবেই।'

কোভিড–১৯ রোগীর মরদেহ সৎকার নিয়ে এখন যেমন অবস্থা, তখনও পরিস্থিতি অনেকটা এমন ছিল বলেই জানালেন সুষমা দাশ। তিনি বলেন, 'কলেরার ক্ষেত্রেও তখন একই চিত্র ছিল। ভয়ে অনেকে দাহও করতেন না। নদীর পাড়ে ফেলে রাখতেন লাশ। কলেরার বিস্তারের সময়টাতে একদিন যাচ্ছিলাম আজমিরীগঞ্জের ঝিলুয়া গ্রামে। পথেই পড়ল আনন্দপুর গ্রাম থেকে আঙারুয়া গ্রাম পর্যন্ত সড়ক। দেখি, সেই সড়কের দাড়াইন নদের পাড়ে সারি সারি লাশ। সব কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। এখন যেমন টিভিতে দেখি, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ বিদেশের রাস্তাঘাটে পড়ে আছে; তখনও এমন দৃশ্য ছিল। কোনো তফাৎ নাই। সে অবস্থা দূর হয়েছে। এখনকারটাও হবে।'

এই লোকসংগীত শিল্পী বলেন, 'আগে বসন্ত হলে কলা গাছের পাতা পেতে সেখানে রোগীকে শুইয়ে আলাদা করে রাখা হতো। কেউ কাছে যেত না, ছুঁত না। পলিথিন তখন ছিল না, তাই কলাগাছের পাতা রোগীর শরীরের নিচে থাকত। এই বসন্ত রোগকেও লোকে মহামারি বলত। এই রোগ হলে রক্ষা ছিল না। এখন তো কত আধুনিক চিকিৎসা এসেছে। আমরা ছোটবেলায় যেসব রোগকে মহামারি ভাবতাম, সেসব এখন কিছুই না। চিকিৎসা কতদূর এগিয়ে গেছে। এই করোনাভাইরাসেরও সমাধান হবে।'

বর্তমানের বন্দীদশা নিয়ে সুষমা দাশ বলেন, 'ঘরবন্দী আছি। মুজিব পরদেশীর সেই গানের মতো—আমি বন্দী কারাগারে। কারও মুখ দেখি না। অনেকের জন্য মন টানে। কিন্তু বাসার বাইরে যেতে পারছি না। শান্তি লাগে না মনে। তবে সুদিন ফিরবে। মানুষ আবার আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে, মহামারি দূর হবে। এটাই দেখার অপেক্ষায় আছি। মনের অশান্তি দূর করার জন্য এখন ঘরে বসে কেবল গান গাই।'