আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি ও হোম কোয়ারেন্টিন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কলেজজীবনে অবসর সময়ে কার্ড খেলা হতো হরদম। সকাল ১০টায় একেক করে সবাই হাজির হতো কার্ড খেলতে। এরপর খেলা চলত একদম দুইটা পর্যন্ত। কোনো কোনো দিন চলত তিনটা পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে আবার সকালে খেলা শেষ করে বিকেলও খেলা শুরু হতো। চলত গভীর রাত অবধি।

সে সময় মাঝেমধ্যে আমার একটা মজার ব্যাপার ঘটত। সব দিন এমন ঘটত না। তবে যেদিন বেশি সময় ধরে কার্ড খেলতাম, সেদিন ঘটত। রাতে ঘুমের মধ্যেও কার্ড খেলছি; এমন চমৎকার স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্ন চমৎকার হলেও ঘুম ভালো হতো না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতাম এবং সারা রাত স্বপ্নে কার্ড খেলতাম। আর মাঝেমধ্যে জেগে উঠতাম।

আজও আমার ভালো ঘুম হয়নি। তবে কলেজজীবনের মতো অনেক বেশি সময় ধরে কার্ড খেলার জন্য নয়। ঘুম হয়নি নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে। আজ রাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লে ঘুম এল। আবারও একটি দুঃস্বপ্ন দেখলাম, আবারও ঘুম ভেঙে গেল। এভাবে সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছি আর বারবার ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।

আজকাল খবরের কাগজ তেমন পড়া হয় না। অনলাইনেই খবরের কাগজ পড়ার কাজ হয়ে যায়। তবে অনলাইনে সবকিছু পড়া হয় না। পড়া হয় শুধু গুরুত্বপূর্ণ নিউজগুলো। এ বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একটা খবর কানে এল। তবে প্রথম প্রথম তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। খবরটি ছিল চীনে ভাইরাস আক্রমণ করেছে।

নিউজ পেপারে প্রতিদিনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা রকম নিউজ থাকে। কোনোটা ভালোর আবার কোনোটা খারাপের। বেশির ভাগ সময় ভালো নিউজের চেয়ে খারাপ নিউজে মানুষ কৌতূহলী হয়। তবুও চীনের ভাইরাসের নিউজ আমার মনে তেমন কৌতূহল তৈরি করল না। তবে কিছুদিন পর প্রতিদিনই চীনের ভাইরাসের খবর আসতে লাগল। তখন বিষয়টা নিয়ে বেশ উদ্বেগ শুরু হলো।

চীনের ভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা তৈরি হলো, যখন দেখলাম আমার এক কাস্টমার তার চীনে মেডিকেলে পড়া ছেলেকে নিয়ে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তখন প্রতিদিন ভাইরাসের আপডেট খবর পড়তে লাগলাম। বুঝতে পারলাম চীনের পরিস্থিতি ভয়াবহ। যত দিন যাচ্ছে, তত বেশি ভয়াবহতার খবর আসতে থাকল। একসময় জানতে পারলাম, চীনে যে ভাইরাস আক্রমণ করছে, তার নাম COVID-19 বা করোনাভাইরাস। এই ভাইরাস শুধু চীনে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বিশ্বের সঙ্গে চীনের দূরত্ব বাড়তে থাকল। আমাদের দেশের অনেক কিছু চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের উহানে ব্যাপকহারে মহামারি ছড়িয়ে পড়ল। পুরো উহান লকডাউন করে হলো। প্রতিদিন উহানে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। তা দেখে আমার উৎকণ্ঠাও বাড়তে লাগল।

দেখতে দেখতে করোনাভাইরাস পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। বর্তমানে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে করোনাভাইরাসের থাবা নেই। প্রতিদিন হাজারো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আমাদের দেশেও মৃত্যুর সংখ্যা নেহাত কম নয়।

২৬ মার্চ হতে আমরা সাধারণ ছুটিতে আছি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবীর সব দেশে লকডাউন অথবা কারফিউ চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ আজ লকডাউনে। শুধু তা–ই নয়, সবাইকে নিজের ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, stay home, stay safe. এই স্লোগান এখন বিশ্বব্যাপী।

ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইন নিউজ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া জুড়ে শুধু একটি খবর—করোনাভাইরাস। প্রতি মুহূর্তে মানুষকে সচেতন করার জন্য রাস্তায় রাস্তায় মাইকিং করা হচ্ছে। যেখানে যাচ্ছি সেখানে শুধু একটি আলোচনা করোনাভাইরাস। সারা বিশ্বের মানুষ আজ করোনার আতঙ্কে আতঙ্কিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্তির পথ একটাই—বাড়িতে থাকুন নিরাপদে থাকুন। কথাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তাই আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। আর মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হলে মানুষকে অবশ্যই বাড়িতে থাকতে হবে।

বাড়িতে থাকার কথা মনে হতেই একটি বইয়ের কথা মনে পড়ল। বইটি বছর ১৫ আগে কিনেছিলাম। একবার নয়, কয়েকবার পড়েছি। বইটির নাম ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’। একজন গৃহবন্দী কিশোরীর আত্মজীবনী। বইটিতে একজন কিশোরী কীভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একটি গোপন আস্তানায় বন্দি জীবন যাপন করেছে, তা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

সময়টা ছিল ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি করুণ কাহিনি। আনা ফ্রাঙ্ক বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন, জার্মানিতে। জার্মানিতে তখন নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের বিরুদ্ধে নিধন শুরু করেছে। ১৯৩৩ সালে আনা ফ্রাঙ্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে হল্যান্ডে পাড়ি জমায়। কিন্তু ১৯৪১ সালে হিটলার হল্যান্ডও দখল করলে শুরু হয় ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। ১৯৪২ সালে আনা ফ্রাঙ্কের বাবার নামে সমন জারি হয়। তখন তিনি নিজের অফিসের পেছনে গোপন আস্তানায় সপরিবারে আত্মগোপন করেন।

সেই গোপন আস্তানায় আনা ফ্রাঙ্ক ছিলেন দুই বছরের বেশি সময়। সারা পৃথিবীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন একটি গোপন আস্তানায় দুর্বিষহ জীবন ছিল তার। বাবা-মা আর কয়েকজন মানুষ ছাড়া কথা বলার আর কেউ ছিল না। ছিল না কোনো বন্ধু, খেলার সাথি, ছিল না সহপাঠী।

গোপন আস্তানায় নিজের একাকিত্বে যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার কৈশোর জীবন, ঠিক তখনই বন্ধুত্ব গড়ে তুলল ‘কিটি’ নামের এক বন্ধুর সঙ্গে। কিটি ছিল তার ব্যক্তিগত ডায়েরি। প্রতিদিন সময় করে লিখে রাখত তার সব কথা। কী লেখেনি তাতে! ডায়েরিতে যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে কিশোরী আনাকে, তেমনি বিস্মিত করে আশ্চর্য গভীর আনাকে।

কিশোরী আনা অবলীলায় লিখেছে দর্শন, ঈশ্বর, মানবচরিত্রের গোপন রহস্য, প্রেম, প্রকৃতি আর জীবনবোধ। সেই সঙ্গে তুলে ধরেছেন সমকালীন ইতিহাস, ইহুদিদের লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা, সংগ্রাম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধরে ছবি।

বড় লেখক হাওয়ার স্বপ্ন দেখত আনা। স্বপ্ন দেখত মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার। আনা ফ্রাঙ্ক আজ বেঁচে নেই। ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট নাৎসি বাহিনী তাদের গোপন আস্তানায় হানা দেয় এবং ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে বন্দী অবস্থায় মারা যায় স্বপ্নবাজ কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক।

আনা ফ্রাঙ্ক মারা গেছে কিন্তু মরেনি তার স্বপ্ন। আজও সারা বিশ্বের শতকোটি অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আদর্শ হয়ে বেঁচে আছে মানুষের মনে আর কর্মে। আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে তার জীবনদর্শনের। অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার সৌন্দর্যে।

গোপন আস্তানায় ছিল শুধু মৃত্যুর মতো এক ভয়ংকর আতঙ্ক। প্রতিক্ষণে, সকালে কিংবা বিকেলে, দিনে কিংবা রাতে, জাগরণে কিংবা ঘুমে একটা বিষয় তার চোখে ভাসত, তা হলো মৃত্যু।

একজন কিশোরী মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যদি এত আশাবাদী হতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না। অবশ্যই পারব। আমরা বাঙালি। আমাদের রক্তে মিশে আছে হাজারো অর্জনের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথ ধরে আমরা দ্রুতই মুক্ত হব করোনাভাইরাসের করালগ্রাস থেকে। সুতরাং আবারও সবাই মিলে একসঙ্গে বলি, স্টে হোম, স্টে সেফ।

*লেখক: ব্যাংকার, উলিপুর, শেরপুর, বগুড়া। [email protected]