বাঁধে বাধা মানেনি আম্পান, ভাসল বিস্তীর্ণ উপকূল

আম্পানের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। ৩নং কয়রা লঞ্চঘাট এলাকা, কয়রা উপজেলা,  খুলনা, ২০ মে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
আম্পানের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। ৩নং কয়রা লঞ্চঘাট এলাকা, কয়রা উপজেলা, খুলনা, ২০ মে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

উপকূলীয় এলাকার নদ–নদীগুলোতে গতকাল সকাল থেকেই পানি বাড়তে শুরু করে। স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা ৫ থেকে ৭ ফুট বেশি ছিল। দুপুরের দিকেই অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় ভরা জোয়ারের সময় প্রবল বাতাসে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা।

বিকেলেই জানা যায়, নোয়াখালীর হাতিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

জোয়ারের তোড়ে বাঁধ ভেঙে বরগুনায় আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়। বরগুনার প্রধান তিনটি নদীর পানি দুপুরেই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জোয়ারের তোড়ে বাঁধ ভেঙে দুই উপজেলার আট গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা ও বরগুনা সদরের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব অঞ্চল থেকে প্রশাসন ইতিমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। 

গতকাল সকালেই পায়রা নদীর অধিক উচ্চতার জোয়ারে বরগুনা সদর উপজেলার মাইঠা এলাকার বাঁধের একটি অংশের অন্তত ২০ ফুট বিলীন হয়। এখানে নতুন একটি জলকপাট (স্লুইসগেট) তৈরি করা হচ্ছিল। সকাল ৬টার দিকে বাঁধ ভেঙে মাইঠা, রায়েরতবক, বড় লবণগোলা গ্রাম প্লাবিত হয়। বেতাগী উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাণীপুর গ্রামের তিনটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় দক্ষিণ রাণীপুর, ভাগোলের পার, গ্রেদ লক্ষ্মীপুরা, লক্ষ্মীপুরা ও বিবিচিনি ইউনিয়নের রাণীপুর গ্রাম। 

দুপুরে মাইঠা এলাকার বাসিন্দা বাদল পঞ্চায়েত বলেন, পানি ঢুকে পড়ায় এলাকার রবি ফসলখেত এরই মধ্যে প্লাবিত হয়ে গেছে। এখনো পানি ঢুকছে। সকালেই বরগুনা সদরের ফুলঝুরি এলাকায় বাঁধ উপচে গ্রামে পানি ঢুকে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এলাকার মানুষ।

বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজীব আহসান জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো মেরামত করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্লাবিত গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বাগেরহাটের সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ও রায়েন্দা এলাকায় গতকাল দুপুরেই বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা গ্রামের আশার আলো মসজিদসংলগ্ন এলাকায় বাঁধের অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢোকে। রায়েন্দা বাজার এলাকায় পানির চাপে বাঁধে ফাটল দেখা দিলে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ মাটি দিয়ে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করে।

বগী গ্রামের মোকলেসুর রহমান বলেন, ‘সিডরের পর থেকে এই বাঁধটা এলাকার মানুষের দাবি ছিল। বাঁধ না থাকলে এলাকা ধইরে তলায় যাবে। বাঁধ থাকলে আমরা বাঁচব।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান বলেন, শরণখোলা এলাকায় বলেশ্বর নদের পানি প্রায় ৭ ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। রায়েন্দা বাজারের পাশে বাঁধে যে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বগী ও গাবতলা এলাকার বেড়িবাঁধের দিকে বিশেষ নজর রয়েছে। পানি বাড়লে ওই এলাকায়ও তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরু করা হবে।

বিকেল ৫টার দিকে বাগেরহাটে বাতাসের গতিবেগ বাড়ে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে উপকূলীয় উপজেলা মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায়। 

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, পদ্মপুকুর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ১৫টি স্থানের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে কয়েকটি স্থান বাঁধের ফাটল দিয়ে এলাকায় পানি ঢুকছে।

গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের অন্তত ১১টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পানিতে তলিয়েছে অন্তত ১২টি গ্রাম। লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রামের রাস্তা, খেত, বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে। যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। মানুষজন যে রান্না করে খাবে, সে অবস্থা পর্যন্ত নেই। এই গ্রাম রাবনাবাদ নদের পাড়ে অবস্থিত। গ্রামের পাশ দিয়ে একসময় ছিল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এ বাঁধের ক্ষতি হয়। এরপর কয়েক দফা মেরামত করা হয়। পরে বাঁধটি নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে আম্পান আঘাত হানার আগেই অনায়াসে পানি ঢুকতে শুরু করে। শুধু চাড়িপাড়া গ্রাম নয়; পাশের চৌধুরীপাড়া, পশুরবুনিয়া, নাওয়াপাড়া, বড় পাঁচ নং, ছোট পাঁচ নং, ধঞ্জুপাড়া, মঞ্জুপাড়া, চান্দুপাড়া, চর চান্দুপাড়া, বুড়োজালিয়া, মুন্সীপাড়া গ্রামও পানিতে তলিয়ে গেছে। সাগর মোহনার রাবনাবাদ নদের পাড়ের এসব গ্রামের ৫০-৬০টি বাড়িঘর জোয়ারের চাপে ভেঙে গেছে। চাড়িপাড়া গ্রামের মানুষজনের চলাচলের আড়াই কিলোমিটার ইট বিছানো সড়কটিরও মাটি, ইট খসে পড়েছে। সড়কটির ওপর দিয়ে এখন ৩-৪ ফুট পানি প্রবাহিত হচ্ছে। 

চাড়িপাড়া গ্রামের ফোরকান প্যাদা বলেন, গ্রামের পুকুর, ঘেরের মাছ, কয়েক শ হাঁস-মুরগি জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার আগেই মানুষজনের অবস্থা চরম বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পুরো ঝড় যখন আঘাত হানবে, তখন পরিস্থিতি কী হবে, তা বলা মুশকিল। 

চাড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া বেগম স্বামী-সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ঘরডাই আছেলে মোর একমাত্র সম্বল। হেইডা জোয়ারে ভাইস্যা গেছে। হাঁড়ি-পাতিল কিচ্ছু রক্ষা করতে পারি নাই। চাইর হাত-পায়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আইয়া উঠছি।’ 

রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, লালুয়া ইউনিয়নের ওই গ্রামগুলোর পাশের ৭ কিলোমিটার বাঁধ বহুদিন আগেই বিলীন হয়েছে। ফলে একটু জোয়ারের চাপ বাড়লেই ওই সব গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বড়মাছুয়া স্টিমারঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। বালুভর্তি ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে।