রাতের আঁধারে অসহায়-অভুক্তদের খুঁজে 'উপহার' পৌঁছে দেন তাঁরা

সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন ঈদ উপহার। ছবি: প্রথম আলো
সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন ঈদ উপহার। ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকায় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী তরুণের সংগঠন ‘সেবা ফাউন্ডেশন’। সংগঠনটি এর আগে গোয়াইনঘাট এলাকার গরিব ও অসহায় পরিবারের অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহায়তা করত। স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্নজনের অনুদান সংগ্রহ করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত উপজেলার প্রায় অর্ধশত অসহায় পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়ে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারা।

তবে দেশে করোনার (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সেবা কার্যক্রমের ধরন বদলে দিয়েছেন এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। গত দেড় মাস তাঁরা জাফলং ইউনিয়নের ৫৫০টি পরিবারকে খাদ্য উপকরণ ‘উপহার’ হিসেবে তুলে দিয়েছেন। যাঁদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অধিকাংশ দিনমজুর পরিবারের। সহায়তা গ্রহণকারীরা যাতে সংকোচ বোধ না করেন, সে জন্য সেগুলো দেওয়া হয়েছে রাতের আঁধারে।

গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা একত্র হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর আগে সংগঠনের পক্ষ থেকে ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জীবাণুনাশক ছিটানো হয়েছিল। পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনটি মুঠোফোন নম্বর প্রচার করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে খাদ্যসংকটে থাকা পরিবারের সদস্যরা কল করে জানালে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা পৌঁছে দিতেন খাদ্যসহায়তা।

এই কর্মসূচিকে সংগঠনের পক্ষ থেকে নামকরণ করা হয়েছে ‘উপহার’ প্রকল্প। গ্রহীতাদের পরিচয় গোপন রেখে এসব উপহার রাতে পৌঁছে দিচ্ছেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। সহায়তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে পরিবারের শিশুসন্তান থাকলে তাদের জন্য দুধ ও পুষ্টিকর সবজি হিসেবে দেওয়া হচ্ছে মিষ্টিকুমড়া।

জানা গেছে, গোয়াইনঘাটের জাফলং পাথর ও পর্যটন–অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় অধিকাংশই পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা, পাথরশ্রমিক ও দিনমজুর পরিবারের বাস। করোনা–পরিস্থিতিতে পাথর ভাঙার কল ও সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ এবং লকডাউনে পর্যটকদের আসা–যাওয়া বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। এর মধ্যে সংগঠনটি অসহায় ব্যক্তিদের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু তা–ই নয়, সংগঠনটি পবিত্র রমজান মাসে শুরু করেছে বিনা পয়সার ইফতারি বিতরণ। এতে বিত্তবান ব্যক্তিরাও সংগঠনটির কার্যক্রমে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। রমজানে প্রতিদিনই অসহায় ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্না করা ইফতারি বিতরণ করছেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। এদিকে ঈদ সামনে রেখে ৫০০ অসহায় পরিবারকে ‘ঈদ উপহার’ পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে সংগঠনটি। এর দুই ধাপে ২০০ পরিবারের সদস্যদের ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হয়েছে।

সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ‌্য উপকরণ। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে। ছবি: প্রথম আলো
সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ‌্য উপকরণ। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সংগঠনের সূত্রে জানা গেছে, করোনার সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে মানুষকে সচেতন করাসহ অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম দিকে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের চাঁদা দিয়ে সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে স্থানীয় ও দেশের বাইরে অবস্থান করা প্রবাসীরাও এতে অংশ নেন। অনেকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি অসহায় পরিবারের উপহার হিসেবে বিতরণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও তুলে দিচ্ছেন।

এ ছাড়াও বিনা পয়সার ইফতারি কার্যক্রমে অনেকেই যোগাযোগ করে রান্না করা খাবার সরবরাহ করছেন। পরে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা সেগুলো প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করছেন। গত মঙ্গলবার ঈদ উপহার বিতরণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ওই দিন ১০০ পরিবারকে জাফলং মুসলিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমে ৫০০ অসহায় পরিবারকে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হবে।

সংগঠনের সহসভাপতি আরিফুজ্জামান আবির বলেন, ‘জাফলং পাথর–অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা পাথরশ্রমিকের কাজ করেন। করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এসব পরিবারের সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েন। ইউনিয়নে প্রায় ৩৬টি গ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে যাঁরা খাদ্যসংকটের কারণে চুলা জ্বালাতে পারছেন না, তাঁদের আমরা খাদ্যসামগ্রীর উপহার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’

এই তরুণ বলেন, ‘খাদ্যসামগ্রীকে আমরা ত্রাণ না বলে “উপহার”নাম দিয়েছি। এগুলো যাঁরা গ্রহণ করছেন, তাঁদের মনে যাতে কোনো সংকোচ না থাকে, এ জন্য আমার রাতে সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছি।’ তিনি জানান, তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থেকে কল পাওয়ার পর নিজেরাই গিয়ে খবর নিয়ে যাচাই করছেন, পরিবারটি সত্যিকারের অসহায় কি না। তাঁদের ঘরে খাদ্য মজুত রয়েছে কি না। এর মধ্যে অনেকে নিছক কৌতূহল থেকে তাঁদের কল দিয়ে যাচাই করতে চেয়েছেন। তাঁরা সেগুলো যাচাই করেছেন। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা এলাকায় অসহায় ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন।

সহায়তা গ্রহণকারীরা যাতে সংকোচ বোধ না করেন, সে জন্য সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা রাতের আঁধারে অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ‌্য উপকরণ। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে। ছবি: প্রথম আলো
সহায়তা গ্রহণকারীরা যাতে সংকোচ বোধ না করেন, সে জন্য সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা রাতের আঁধারে অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ‌্য উপকরণ। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাদিম মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমানে আমরা ঈদ উপহার ও বিনা পয়সার ইফতারি বিতরণ করছি। এ ছাড়াও মুঠোফোনে কলের মাধ্যমে উপহার পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। এখন পর্যন্ত (গত দেড় মাসে) মুঠোফোনে কলের মাধ্যমে ৫৫০টি পরিবারের মধ্যে উপহার এবং দেড় হাজার পরিবারের মধ্যে রান্না করা ইফতারি বিতরণ করেছি। ঈদ উপহার বিতরণ করা হয়েছে ২০০ পরিবারের মধ্যে। উপহার বিতরণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আমরা খোলা মাঠ নির্বাচন করেছি।’

নাদিম বলেন, আগামী শনিবার খোলা মাঠে তৃতীয় ধাপে বিতরণের পর বাকি ২০০ পরিবারের কাছে ঘরে ঘরে গিয়ে ঈদ উপহার পৌঁছে দেওয়া হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০০ পরিবারকে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হবে। এতে স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল এবং প্রবাসীরা তাঁদের সহায়তা করেছেন। করোনা–পরিস্থিতিতে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুস সাকিব বলেন, ‘সেবা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা রাতের আঁধারে অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। জাফলংয়ে অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তায় তাঁরা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, এটি আসলেই সমাজে অনুকরণীয়। সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। সংগঠনটির সেবা কার্যক্রমে আমি আমার পক্ষ থেকে সহায়তা দিয়েছি। এ ছাড়াও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।’