আম্পানের ২৮ ঘণ্টার তাণ্ডবে দক্ষিণ থেকে উত্তরে ব্যাপক ক্ষতি

রাতভর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলের জনজীবন। কপোতাক্ষ নদের বাঁধটির পাশেই এই বাড়ির অবস্থান। সকালে এসে দেখা যায় বাড়ির কাঠামো বলতে কিছু নেই। বাড়ির অবশিষ্ট জিনিসপত্র সংরক্ষণ করছেন পরিবারের সদস্যরা। গতকাল খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলায়।  সাদ্দাম হোসেন
রাতভর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলের জনজীবন। কপোতাক্ষ নদের বাঁধটির পাশেই এই বাড়ির অবস্থান। সকালে এসে দেখা যায় বাড়ির কাঠামো বলতে কিছু নেই। বাড়ির অবশিষ্ট জিনিসপত্র সংরক্ষণ করছেন পরিবারের সদস্যরা। গতকাল খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলায়। সাদ্দাম হোসেন

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। গত বুধবার বিকেল চারটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ বাংলাদেশে ঢোকে। অনেকগুলো জেলা, পদ্মা নদী পেরিয়ে পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় এটি রাজশাহীতে ঘূর্ণিঝড়ের গতি নিয়েই আঘাত হানে। যাত্রাপথে ঘূর্ণিঝড়টি ঘরবাড়ি, ফসলের খেত, মাছের ঘের, ফলের বাগানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। সকাল ১০টার দিকে এটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে আরও ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে। সরকারের প্রাথমিক হিসাবে এই ঘূর্ণিঝড়ে ২৬টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

দেশের ছয় জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বগুড়ায় ঝড়ের মধ্যে নৌকা ডুবে দুজন নিখোঁজ হয়েছেন। ঝড়ের পর থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।

বুধবার বিকেল ৪টার দিকে সাতক্ষীরায় এই ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগটি আঘাত হানে। রাত ৯টার দিকে এর কেন্দ্রটি যখন সাতক্ষীরা অতিক্রম করছিল তখন উপকূলীয় প্রায় সব কটি জেলাতেই এর প্রভাবে বাতাসের তাণ্ডব চলছিল। সঙ্গে ছিল জলোচ্ছ্বাস। এরপর সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ ও আশপাশের জেলাগুলো দিয়ে বয়ে গিয়ে পদ্মা পার হয়ে পাবনা ও রাজশাহীতে আঘাত হানে আম্পান। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এটি রাজশাহীতে ঘূর্ণিঝড়ের গতি নিয়েই ঢোকে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই সেটি প্রবল বৃষ্টি ঝরিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। এই নিম্নচাপের প্রভাবে রাত ৮টার দিকেও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি ও দমকা বাতাস বইছিল।

ঘূর্ণিঝড়টি সুন্দরবনের ওপর তিন ঘণ্টা তাণ্ডব চালায়। সুন্দরবনের কারণে লোকালয়ে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ১৯৬০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যে কটি ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য রয়েছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ও বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে খুলনা–যশোর হয়ে ফরিদপুর–রাজবাড়ী দিয়ে পাবনা হয়ে এটি রাজশাহী ও নওগাঁয় প্রবেশ করে। ঝড়ের সময় এসব এলাকায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ৬২ থেকে ১৫১ কিলোমিটারের মধ্যে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। আম্পান যেভাবে উপকূল পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে তীব্র গতি নিয়ে উত্তরাঞ্চালে পৌঁছেছে, তা একেবারেই ব্যতিক্রম। সাতক্ষীরা, খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোর মানুষ এ রকম ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখে অভ্যস্ত হলেও বাকি এলাকাগুলোতে এ রকম ঝড় নজিরবিহীন। এ ধরনের তীব্র মাত্রার ঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম।

এর আগে ১৯৮৮ সালে ঘূর্ণিঝড় যশোর-ফরিদপুর পর্যন্ত এসেছিল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন ধরে আমরা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এলাকা বলতে উপকূলকে বুঝতাম। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিতাম। আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকেরাও সব উপকূলীয় জেলার। কিন্তু আম্পান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ থেকে দেশের কোনো এলাকাই মুক্ত না। ফলে সারা দেশেই এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে।’

আম্পানে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে সেটিকেও নজিরবিহীন বলছেন উপকূলের মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল আঞ্চলিক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘এবারের জলোচ্ছ্বাস আমাদের জন্য একটি ভীতিকর ইঙ্গিত দিল। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অনেক বেড়েছে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫১ কিলোমিটার পাওয়া গেলেও যশোর বিমানবন্দরের রাডার স্টেশনে রাত সাড়ে নয়টায় পাওয়া গেছে ১৬৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে ১২২ কিলোমিটার, খুলনায় ১১০, পাবনায় ৯৬ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বয়ে গেছে। আর রাজধানীতে বুধবার বাতাসের সর্বোচ্চ গতি পাওয়া গেছে ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার। এসব জেলায় খেতের ফসল, গাছের আম-লিচুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, চিংড়ির ঘের। কয়েক হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

২৬ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যমতে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে দেশের পাঁচ জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার রাতে যশোরে ঘরের ওপর গাছ পড়ে মা-মেয়েসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার রাতে যশোরের বিভিন্ন উপজেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে যশোরের শার্শা উপজেলায় ৪ জন, চৌগাছায় ২, বাঘারপাড়ার ১ ও মনিরামপুর উপজেলার ৫ জন রয়েছেন।

গাছ পড়ে, পানিতে ডুবে ও পড়ে গিয়ে পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরায় ও ঝিনাইদহে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। পিরোজপুর ও রাজশাহীতে আতঙ্কে দুজন মারা গেছেন।

তবে সরকারি হিসাবে আম্পানে ১৬ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার গতকাল সন্ধ্যায় এ তথ্য জানান।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মোট ২৬ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা। মোট পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আমের ক্ষতি বেশি। এ ছাড়া ১৩ জেলার প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার বাঁধ ভেঙেছে। ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে এসব ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটির টাকা। তবে সরকার বলছে, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে।

কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গতকাল বিকেলে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জেলায় ৪৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমির আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছিল, ৩ হাজার হেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলায় ঝরে পড়া আমগুলো কিনে ত্রাণ হিসেবে দুস্থ জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান কৃষিমন্ত্রী। এ ছাড়া ভুট্টা, পাট, পান, সবজি, চিনাবাদাম, তিল, লুচি, কলা, পেঁপে, মরিচ, সয়াবিন ও মুগডালের ক্ষতি হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের নানাভাবে সহায়তা করার কথা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ১৫ মে পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ফলে কৃষিতে ব্যাপকভিত্তিক ক্ষতি হয়নি।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১৩ জেলার ৮৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙেছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার। গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এসব কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আম্পানে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত ৮ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন জেলার বেড়িবাঁধ বা তীররক্ষা বাঁধ কোথাও ভেঙে বা কোথাও উপচে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে।

এদিকে গতকাল বিকেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সব মিলিয়ে প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মোট ২৬টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০টি ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ চিংড়িঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আম্পানে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলোচ্ছ্বাসে বন বিভাগের ৬০টির বেশি পুকুরে লবণাক্ত পানি ঢুকেছে। সুন্দরবনের গাছগাছালির মধ্যে কেওড়াগাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা
আম্পানের কারণে দেশের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরের ২৫ জেলার দেড় কোটি গ্রাহক ঝড়ের আগেই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন। এসব জেলার বেশির ভাগ স্থানে ঝড় শুরু হওয়ার ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা আগেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো। আর ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় অনেক জায়গায় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। গতকাল সন্ধ্যায় সারা দেশে এক কোটির বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিলেন বলে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে।