'সবাই বলে তুমি মেয়ে মানুষ, আগে বাড়ি যাও'

সীমা রানী। ছবি: সংগৃহীত
সীমা রানী। ছবি: সংগৃহীত

সীমা রানীর বিয়ে হয়েছে গত ১১ মার্চ। বিয়ের পর মাত্র এক সপ্তাহ স্বামী ও অন্য সদস্যদের কাছে পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই কর্মক্ষেত্রে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ, সাইক্লোন আম্পানসহ বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে জনগণকে রক্ষায় ও সচেতন করতে বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন। তবে সীমা রানী হাসতে হাসতে বললেন, ‘করোনা বা আম্পান থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে সচেতন করতে গেলে সবাই বলে, “মেয়ে মানুষ, তুমি আগে বাড়ি যাও।” তখন বলি, আপনারা ঘরে থাকলে, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে বা নিরাপদ থাকলে আমিও দ্রুত ঘরে ফিরতে পারব। আপনারা যত দেরি করবেন, আমার বাড়ি ফেরাও তত দেরি হবে। বেশির ভাগ মানুষই কথা শোনেন, কউ কেউ শুনতে চান না।’

সীমা রানী বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অতিদরিদ্র বিমোচন কর্মসূচিতে (আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন) প্রোগ্রাম অর্গানাইজার হিসেবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া শাখায় কর্মরত। ১০৩টি পরিবারকে বাল্যবিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব পালন করেন। উঠান বৈঠক করেন। বাড়ি পরিদর্শন করেন। নতুন করোনাভাইরাস বিস্তারের পর এ ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে কী করতে হবে, সে বিষয়ে সচেতন করছেন।

বুধবার সারা দেশে নতুন দুর্যোগ সুপার সাইক্লোন আম্পান নিয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। আম্পানে যাতে মানুষের জানমালের ক্ষতি না হয়, সে জন্য সীমা দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে মাইকিং করাসহ সচেতনতামূলক কাজ করেছেন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে টেলিফোনে সীমা বললেন, ‘আমি তো মানুষ, ভয় আমারও লাগে। করোনার বিরুদ্ধে লড়তে হ্যান্ড গ্লাভসসহ বিভিন্নভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে কাজ করছি। আম্পানেও বিশেষভাবে সতর্ক থেকেছি। কিন্তু নিজে ভয় পেলে তো চলবে না, আমার দায়িত্বটাই অন্যদের সচেতন করা। আর কাজ করছি অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর সঙ্গে, যাদের সচেতনতা আসলেই অনেক কম। অনেক সময় সচেতন হলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে সব নিয়মকানুন মানতেও পারে না।’

পটুয়াখালীতে সীমা রানীর কর্ম এলাকায় আম্পানের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়েছে বলে টেলিফোনে জানালেন সীমা রানী। তবে দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না, মুঠোফোনে চার্জ ছিল না জানিয়ে বললেন, ‘আমি মানুষকে সচেতন করে ঘরে ফিরলেও রাজবাড়ীর পাংশায় থাকা মা-বাবা, ঢাকায় থাকা স্বামী উত্তম বিশ্বাসসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ফোনে পাচ্ছিলেন না বলে চিন্তাটা বেশি ছিল তাঁদের। বিদ্যুৎ আসার পর মুঠোফোনে চার্জ দিয়ে সবার আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছি আমি ভালো আছি।’

দুই বছরের বেশি সময় ধরে সীমা রানী ব্র্যাকে কাজ করছেন। এর আগে মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরগুনায় কাজ করেছেন। মার্চের ২৫ তারিখ থেকে তিনি বর্তমান কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে বিভিন্ন বাড়িতে যেতে অটো-ভ্যান-রিকশা বা ট্রলারে যাতায়াত করতে হয়। সীমা রানী ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘পারিবারিকভাবে ১১ মার্চ বিয়ে, বিয়ের পর মাত্র ৭ দিন শ্বশুরবাড়ি ছিলাম। স্বামীর সঙ্গে ২১ মার্চ শেষ দেখা হয়েছিল। এখন পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাড়ি ফিরতে পারছি না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, স্বামীর চেহারাই তো ভুলে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যরা শুধু জানতে চান, কবে বাড়ি ফিরব? আশীর্বাদ করবেন, যেন খুব দ্রুত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারি। ছুটিতে বাড়ি ফিরতে পারি।’

সীমা রানীর গলায় বেশ খানিকটা আত্মবিশ্বাস, এখন পর্যন্ত তাঁর নিজের বা তাঁর কর্ম এলাকার ১০৩টি পরিবারের কোনো সদস্যের করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়নি, বা কেউ অসুস্থ হননি।