সেই নবজাতক পেল নতুন মা-বাবা

তত্ত্বাবধায়ক দম্পতির হাতে তুলে দেওয়ার আগে নার্সের কোলে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতক। গতকাল বৃহস্পতিবার। ছবি: প্রথম আলো
তত্ত্বাবধায়ক দম্পতির হাতে তুলে দেওয়ার আগে নার্সের কোলে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতক। গতকাল বৃহস্পতিবার। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের মানসিক ভারসাম্যহীন সেই নারীর নবজাতক শিশুকে একটি নিঃসন্তান দম্পতিকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। স্থানীয় প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই শিশুকে নড়িয়ার একটি পরিবারকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন। নিঃসন্তান ওই দম্পতি গতকাল বৃহস্পতিবার পরম যত্নে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন।

গত শনিবার (১৬ মে) শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন। কেউ ওই নারীর নাম–পরিচয় জানেন না, জানেন না ওই শিশুর বাবার পরিচয়। বুধবার ভোরে (২০ মে) সকালে হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে নবজাতককে ফেলে চলে যান ওই নারী। এ নিয়ে প্রথমে গত সোমবার (১৮ মে) প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণে ‘পাগলিটা মা হলো, বাবা হলো না কেউ’ এবং পরে ওই দিন অনলাইনে ‘করোনাকালে হাসপাতালে একচিলতে সুখ হয়ে এসেছে এক “পাগলির” নবজাতক’ শিরোনামে দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। বুধবার (২০ মে) অনলাইনে আর প্রকাশ হয় ‘নবজাতক হাসপাতালে ফেলে চলে গেলেন সেই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী’।

এরপর ওই শিশুকে নেওয়ার জন্য চারটি পরিবার জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের শিশু আদালতে আবেদন করে। আদালত পরিবারগুলোর সামাজিক অবস্থান, সক্ষমতা বিবেচনা করে নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের এক নিঃসন্তান দম্পতিকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন। ওই শিশুর যাবতীয় খোঁজখবর রাখার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের জেলা প্রবেশন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। ওই কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতক। ছবি: সংগৃহীত
মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতক। ছবি: সংগৃহীত

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সন্তান প্রসব করার পরই তাঁকে ও শিশুকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রক্রিয়া করতে করতেই ওই নারী তাঁর নবজাতককে ফেলে হাসপাতাল থেকে চলে যান। তখন কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই। অবশেষে আদালতের মাধ্যমে ওই শিশুকে এক পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’

নড়িয়া থানা সূত্র জানায়, গত শনিবার (১৬ মে) বিকেলে পুলিশের কাছে খবর আসে, নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক ভারসাম্যহীন নারী গাড়ির নিচে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। স্থানীয় লোকজন ওই নারীকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছিলেন না। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নড়িয়া থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ গিয়ে দেখেন, ওই নারী প্রসববেদনায় ছটফট করছেন। দ্রুত তিনি তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদনে নিয়ে যান। সেখানে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রসব করাতে না পেরে রাত ১০টায় তাঁকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে পাঠান। শনিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।

ওই নারী চার দিন হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে থাকলেও সন্তানের কোনো যত্ন নেননি। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার ভোরে কাউকে কিছু না বলে নবজাতক ফেলে হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন। প্রসূতি ওয়ার্ডের শয্যায় ওই নবজাতক যখন কান্না করছিল, তখন সবার নজরে আসে, তার মা আশপাশে নেই। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ আর ওই নারীকে খুঁজে পায়নি।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে জন্ম নেওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতককে তত্ত্বাবধায়ক পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে জন্ম নেওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতককে তত্ত্বাবধায়ক পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান বলেন, ‘ওই নারী তাঁর নবজাতককে ফেলে চলে যাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়ে যাই। আদালতের মাধ্যমে শিশুটি নতুন পরিবার পেয়েছে। আল্লাহ সহায় থাকলে তার জীবনটাই পাল্টে যাবে।’

সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা তাপস বিশ্বাস বলেন, শিশুটির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত একটি পরিবারকে দায়িত্ব দেন। ওই শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য চারটি পরিবার আদালতে আবেদন করে। সবদিক বিবেচনা করে শিশু আদালতের বিচারক আবদুস সালাম খান নড়িয়ার এক নিঃসন্তান দম্পতিকে শিশুকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত ওই শিশুর খোঁজখবর রাখতে হবে, তা আদালতে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সদর হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে ওই দম্পতির এক স্বজনের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহাবুবুর রহমান শেখ, সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসলাম উদ্দিন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা তাপস বিশ্বাস।

রাস্তা থেকে উদ্ধার মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সন্তান প্রসব করেছেন। শিশুটিকে ঘিরে আনন্দিত নার্স ও চিকিৎসকেরা। গত সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। ছবি: প্রথম আলো
রাস্তা থেকে উদ্ধার মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সন্তান প্রসব করেছেন। শিশুটিকে ঘিরে আনন্দিত নার্স ও চিকিৎসকেরা। গত সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। ছবি: প্রথম আলো

শিশুটিকে ছয় দিন দেখাশোনা করেছেন সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সাদিয়া আক্তার। শিশুকে হস্তান্তর করার সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পাগলির শিশুটিকে পেয়ে আমরা অন্য রকম সুখ অনুভব করছিলাম। ছয় দিনেই মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল। ওকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমরাই আর কীভাবে ওকে রাখব? এরপরও আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে, মেয়েটির অন্তত একটি নিরাপদ আশ্রয় হলো।’

নড়িয়ার ওই পরিবারটি নারায়ণগঞ্জে থাকে। ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। নবজাতককে পেয়ে তাঁরা উৎফুল্ল ও আনন্দিত। কথা হলে প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের প্রতি সহায় হয়েছেন। তাই একটি সন্তান উপহার দিয়েছেন। আমাদের সব চেষ্টা ও পরিশ্রম দিয়ে তাকে গড়ে তুলব।’