হাজার বছর কোয়ারেন্টিনে মায়েদের কষ্ট বুঝতে পারছি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমি সদ্য স্নাতক। ভেবেছিলাম জুন থেকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হবে, তাই মাঝের এই লম্বা ছুটিতে খুব ঘুরতে যাব, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাব, বন্ধু–বান্ধবীরা অনেক মজা করব, আরও কত কী যে করব। কিন্তু প্রকৃতির কাছে, স্রষ্টার কাছে মানুষ সত্যিই বড় অসহায়। এক অদৃশ্য শক্তির কাছে সবাই আজ মাথা নত করেছি। এই অদৃশ্য দানব বড়-ছোট, বৃদ্ধ-জোয়ান, ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ কিছুই বুঝে না। তার শুধু আত্মা পছন্দ। সে মানবদেহ থেকে আত্মাটা নিয়ে যায়, নিথর দেহটাকে ফেলে রেখে যায়।

হয়তোবা মানবের উদ্যত আচরণের কারণে প্রকৃতি আজ এই ভয়ানক দানবের বেশে এসে প্রতিশোধ নিচ্ছে। অথবা মানবের ভুলে যাওয়া মানবতা, শিষ্টাচার, নম্রতা, সবকিছু আবার নতুন করে শেখাতে স্রষ্টার এক নতুন কৌশল মাত্র করোনা!

আমি মনে করি, মুদ্রার যেমন দুটি পিঠ আছে, ঠিক সে রকম করোনার বেলাতেও ভাবা যায় কিন্তু। এই যে ভয়, আর্তনাদ, আহাজারি, আক্ষেপ বাদেও যদি দেখি করোনা বিশ্বকে অনেক নীতি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে৷ নীতিশিক্ষা কারোরই তেমন পছন্দ নয়, তাই হয়তোবা আমরা এড়িয়ে চলতে চাই।

গত ১ মার্চ কুমিল্লা থেকে এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দিয়ে। তারপর থেকে যে বাসায় আছি, এখনো বাসায়। অভিজ্ঞতার কথা যদি বলি, এই করোনাতে ভালো–খারাপ দুরকম অভিজ্ঞতাই রয়েছে। শুরুর দিকে এই মৃত্যুর তাণ্ডব, মানুষের নানান নেগেটিভ পোস্ট, শেয়ারিং, গরিব মানুষগুলোর কষ্ট, এই ক্রান্তিলগ্নেও মানুষের বিকৃত মস্তিষ্কের কার্যকলাপ দেখে খুব ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভ করে রেখেছিলাম কিছুদিন। বাসায় পত্রিকাও আর আসে না এখন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ নেই। খুব খারাপ কাটছিল সময়। তারপর বাসায় আম্মাকে কাজে সাহায্য করা শুরু করলাম; বই অবশ্য আমি সব সময়ই পড়ি, এইবার পরিমাণ বেড়ে গেছে এই যা, মাঝেমধ্যে কিছু রান্নাবান্নাও করি।

করোনার আশীর্বাদের দিকটা দেখি তাহলে বলব, করোনা আমাকে নতুন করে অনেক কিছু গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করে দিয়েছে। হাজার বছর ধরে কোয়ারেন্টিনে থাকা মায়েদের কষ্ট সন্তানেরা এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। এই যে মায়ের সঙ্গে এখন গল্প করি, হাসি, আড্ডা দিই। দেখি যে আমার মা কত সুন্দর হাসতে পারে, মায়ের হাসিটা কত সুন্দর। পেঁয়াজ, মরিচ, এই সেই কত কিছু কাটাকাটি করতে করতে যে মায়ের আঙুলগুলোতে দাগ হয়ে গেছে, কেটে একদম ফালিফালি হয়ে গেছে, তা আগে খেয়াল করিনি। ওই ক্ষততে গরম ভাপ বা মসলাজাতীয় কিছু লাগলে যে তা জ্বালাপোড়া করে, তা আগে কোনোদিন জানা হয়নি।

আগে তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বন্ধু, আড্ডা, পড়ালেখা এবং নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে সবকিছুর মধ্যে এসব দেখার সুযোগই পেতাম না বা হয়তো দেখেও উপেক্ষা করেছি। রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করতে যেয়ে এখন বুঝি, রোজা রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ ভাজতে আগুনের তাপে কতটা খারাপ লাগে, কোমরে ব্যথা হয়ে যায়। আমরা তো শুধু পছন্দের খাবারের তালিকা ধরিয়ে দিতাম, আর সুন্দর পরিবেশন দেখে খুশি হয়ে যেতাম। এই মজাদার খাবারের পেছনের শ্রমটা হয়তো এখন বুঝি। কারণ, এখন মনোযোগ দিচ্ছি, বুঝতে চেষ্টা করছি। আমরা সন্তানেরা যখন কেউ বাসায় থাকি না, একা একা মায়ের কতটা অদ্ভুত লাগে, এখন বুঝি।

স্রষ্টা হয়তো একদিন সদয় হবেন, পৃথিবী সুস্থ হবে, লকডাউন উঠে যাবে; কিন্তু মায়েদের লকডাউন আদৌ উঠবে কি না, কে জানে। তাঁরা সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিন গ্রহণ করেছেন। করোনা আমাদের হয়তো শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে যেন আমরা আমাদের মায়েদের লকডাউন উঠিয়ে দিই, তাঁদেরও আড্ডা, হাসি, গল্প–গুজবের সুযোগ করে দিই। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা সত্যিই অসাধারণ কিউট। করোনা আমাকে এই কিউটনেসের শিক্ষা দিয়েছে। করোনাতে আরও একটা ভালো অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আগে শুধু গল্পের বই পড়তাম। আর এখন পড়ার যোগ্য যেকোনো কিছু ধরিয়ে দিলে আমি খুব মনোযোগসহকারে পড়তে পারি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এখন শুধু এটাই প্রার্থনা—এই পৃথিবীতে গতি আসুক, আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যাক, নতুন শিক্ষা নিয়ে শুরু হোক আবার মানুষের সচেতন পথচলা। আবার না হয় পরের বছর সুস্থ পৃথিবীতে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরবে, ঈদের শুভেচ্ছা জানাবে, প্রতিবেশীদের ইফতারের দাওয়াত দেবে, মসজিদগুলোতে লোকসমাগম হবে।

আশায় রইলাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিস, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, কুমিল্লা। গোমতী ভবন, দাতিয়ারা ওয়াপদা কলোনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। [email protected]