করোনা, কবে করুণা করবে

পৃথিবীর মহা শক্তিশালী দেশগুলোকে একেবারে কুপোকাত করে করোনা এখন আমাদের দরজায়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়েছিল এ বছরের ৮ মার্চ। দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে তিন মাসে পড়েছে। চ্যানেল আই, সময় টিভি, বিবিসিসহ মোটামুটি সব চ্যানেলই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রতিমুহূর্তে করোনার পরিস্থিতি দেখছি। প্রথম প্রথম প্রতি ঘণ্টায় অন্য অনেক চ্যানেলে ঢুঁ মারলেও এখন এই তিনটিতেই করোনার খবর দেখি। একই খবর সারা দিন দেখাত বলে আগে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হতাম, টেলিভিশন বন্ধ করে দিতাম। একটু পরই আবার দেখতাম, নতুন কোনো খবর আছে কি না। তারপর খেয়াল করলাম, প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর আইইডিসিআরের হালনাগাদ খবর দেওয়া হয়। দেশের পরিস্থিতি জানতে ওই সময়টার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। প্লেগ, কলেরা, স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মহামারির ১০০ বছরের অলিখিত পরিক্রমায় ২০২০-এর এই করোনা আক্রমণ।

অবশ্য মুদ্রার তো দুই পিঠই আছে। সেই ১৯২০ সালে কজনের ঘরে টেলিফোন, টেলিভিশন ছিল? আমাদের স্বজন-সন্তানদের ঘরে যথেষ্ট খাবার আছে তো, ওরা না খেয়ে থাকছে না তো—সাত সমুদ্র তেরো নদীর অন্য পাড়ে থাকলেও আমরা এখন ঘরে বসেই স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে দিব্যি বিনা পয়সায় হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো বা মেসেঞ্জারে তাদের খবর নিচ্ছি, স্বস্তি অনুভব করছি।

টেলিভিশনে মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনে দেখছি এক ছেলে বাবাকে বলছে, ‘তোমার গলাটা খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল।’ বাবা বলছেন, ‘বাবা, তুই বাইরে যাস না তো? ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছিস তো?’ মেয়ে মাকে বলছে, ‘মা, তুমি একদম কথা শোনো না।’ মা উত্তর দিচ্ছেন, ‘কই শুনলাম না?’ মেয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘ওষুধগুলো সব নিয়মমতো খাচ্ছ তো?’ ছোট ভাইকে বড় ভাই বলছে, ‘আর কটা দিন কষ্ট কর, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমরা সবাই সেই আশায় আছি। আমার প্রবাসী ছেলেদের সঙ্গে যখন কথা বলি, জানতে চাই, এই করোনা প্যানডেমিকে কেমন আছে ওরা, ওদের উত্তর হলো, ‘আমাদের চিন্তা বাদ দাও। আমাদের কিছু হবে না। এই বয়সে তুমি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছ। দোকানে যাবে না। হোম ডেলিভারিতে অন্তত দুই মাসের চাল-ডাল আর ওষুধ কিনে ঘরে রেখে দাও।’

ময়না, টিয়া পাখিকে খাঁচায় রেখে আমরা অপার আনন্দ পাই। এদের যখন কথা শেখাতে পারি, আমাদের আনন্দ তখন দ্বিগুণ হয়ে যায়। পানিতে বুদ্‌বুদ উঠিয়ে, রঙিন আলোয় ভরা অ্যাকুয়ারিয়ামে সোনালি-রুপালি মাছ ছেড়ে দিয়ে আমরা শিশুদের আনন্দের খোরাক জোগাই। বদ্ধ অবস্থায় ওদের মানসিক চাপের কথা কি আমরা আগে কখনো চিন্তা করেছি? এখন তার কিছুটা হলেও আমাদের ধারণা হচ্ছে।

১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে ২০১৫-তে চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৯ বছর। এর মধ্যে উচ্চতর পড়াশোনা আর অন্যত্র চাকরির সুবাদে ৮-৯ বছর বাদ দিলে জীবনের সিংহভাগ সময় ঐতিহাসিক কার্জন হলের বিভাগীয় ক্লাসরুম আর নিজের বসার ঘরেই কেটেছে। ছাত্রজীবনে সপ্তাহের পাঁচ দিনই সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দিনে অন্তত দুবার এবং শিক্ষকতা জীবনের তিন দিন নয়টা থেকে পাঁচটা আর দুদিন নয়টা থেকে দুইটার মধ্যে তিন-চারবার চা-শিঙাড়া খাওয়া চলত। কার্জন হলের প্রতিটি ইটপাথরের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা অটুট আছে, থাকবে।

আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু নাসরিন শামস চৌধুরী—ছোটবেলা থেকে একই সঙ্গে আমরা গান শিখেছি, একই বিষয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরি করেছি। অবসর নিয়েছি পাঁচ বছর হয়ে গেছে। তবু এখনো আমরা দুজন কিছুদিন পরপরই সেই কর্মস্থলে যাই চা আর শিঙাড়া খেতে। মিলনের ক্যানটিনে বালতির পানিতে চুবিয়ে ধোয়া ছোট ছোট কাপের দুপাশ গড়িয়ে পড়া টিনের দুধের চা আর শিঙাড়া খাওয়ার তৃপ্তি আর কোথাও পাওয়া যায় না। কেউ সোনারগাঁ বা শেরাটনের চা এবং এই চায়ের মধ্যে বেছে নিতে বললে আমরা চোখ-কান বন্ধ করে এটাই চাইব। যত দিন বেঁচে থাকব, শারীরিক আর মানসিকভাবে সুস্থ থাকব, কার্জন হলের আকর্ষণ আমাদের কমবে বলে মনে হয় না।

বিভাগে এখনো শিক্ষক হিসেবে আমাদের বেশ কিছু ছাত্র কর্মরত আছে। ল্যাব টেকনিশিয়ান আর বেয়ারাদের মধ্যে এখনো আছে বেশ কিছু চেনা মুখ। এই কোভিড-১৯-এর ঘরবন্দী সময়ে অনেকেই মাঝেমধ্যে খবর নেয়। যখনই যেতাম, কমনরুমে বসে আমরা চা-শিঙাড়া খেতাম। সবাই খবর পেয়ে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসে দেখা করে যেত, গল্প করত। খবর পেলেই নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে যেত বিভাগীয় চেয়ারম্যান। চা খাওয়াত আবারও। এই অভিজ্ঞতা আর পাওয়াগুলো বড়ই মধুর, যেখানে স্বার্থ বা পরশ্রীকাতরতার ছোঁয়া নেই। এলপিআরে থাকাকালীন একবার বিভাগে ঘুরতে গেলে আমাদের এক জুনিয়র শিক্ষক খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আপা চলেন, আজ আমার বাসায় চা খাবেন।’ নাসরিন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দূর, তোমার বাসার চায়ে কি মিলনের চায়ের মজা পাব? বরং ওখানে চা খেয়ে তোমার বাসায় গিয়ে গল্প করব।’

এখনো প্রতিদিনই আমরা অন্তত একবার কথা বলি। আমার বন্ধু বারবারই বলতে থাকে, ‘কবে আমরা ডিপার্টমেন্টে যাব আর চা খাব?’ আমি ওকে একই উত্তর দিই, ‘করোনা যেদিন করুণা করবে।’