'গোলাখালী' দ্বীপের মানুষের কষ্ট ফোরায় না

আম্পান বয়ে যাওয়ার পর গোলাখালী দ্বীপ। ছবি: মনিরুল ইসলাম
আম্পান বয়ে যাওয়ার পর গোলাখালী দ্বীপ। ছবি: মনিরুল ইসলাম

ভেটখালী খেয়াঘাট থেকে যন্ত্রচালিত নৌকায় উঠলাম। মাদার নদীর তীর ধরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকা এগিয়ে চলল। ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ‘গোলাখালী’ পৌঁছালাম। এই দ্বীপের সঙ্গে সড়কপথে কোনো যোগাযোগ নেই। চুনো, মাদার আর কালিন্দী নদী দিয়ে দ্বীপের চারপাশ বেষ্টিত। এই দ্বীপে ৭৮টি পরিবারের বসতি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ দিয়ে দ্বীপের চারপাশ বাঁধা রাখা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নে এই দ্বীপটি অবস্থিত।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দ্বীপের সবারই ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সবারই ঘরবাড়ি কাঁচা। ইট-সিমেন্টের কোনো দালান নেই এখানে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে প্রায় সব ঘরবাড়ির চাল উড়ে গেছে। যদিও ঝড়ের রাতে দ্বীপের বাসিন্দাদের কাউকে ঘরে থাকতে দেয়নি কোস্টগার্ড। সবাইকে নদীর ওপারে নৌবাহিনী ফাঁড়িতে নিরাপদে নিয়ে রাখা হয়। এ জন্য কেউ প্রাণ হারায়নি।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন দেখা গেল, নওশের সরদারের একটিমাত্র বসতঘর। সারা জীবনের সঞ্জয় ও ধারদেনা করে বছর দুয়েক আগে মাটির দেয়াল তুলে ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে ঘরটি তিনি নির্মাণ করেন। ওই ঘরের টিন ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মাটির দেয়াল বৃষ্টির পানিতে ধসে পড়ছে।
নওশের সরদার বলন, ‘ধারদেনা করে ঘরটি নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ঘরটি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এখন আমি কী করব? আমাদের সহায়তা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।’
শুধু নওশের সরদারের ঘর না, এই দ্বীপ গ্রামের মোমিন আলী, হালিমা খাতুনের মতো প্রায় সবারই ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

আবার ঘর বাড়ি মেরামতে ব্যস্ত গোলাখালী দ্বীপের মানুষ। ছবি: মনিরুল ইসলাম
আবার ঘর বাড়ি মেরামতে ব্যস্ত গোলাখালী দ্বীপের মানুষ। ছবি: মনিরুল ইসলাম

আট বছর আগে হালিমা খাতুনের স্বামী সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকারে যান। বাঘের আক্রমণে তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সতীর্থরা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেই তিনি মারা যান। এরপর হালিমা আর বিয়ে করেননি। দুই ছেলেকে নিয়ে দুর্দশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। ১০ বছর বয়সের বড় ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। এই ঝড়ে তাঁরও ঘরের চালের টিন উড়ে গেছে।
হালিমা খাতুন বলেন, ‘দুই ছেলেকে নিয়ে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। তার মধ্যে ঝড় আমার ঘর কেড়ে নিল।’
মোমিন আলী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। তাঁর দুই ছেলে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। প্রতি মাসে দুজনের শরীরে রক্ত দেওয়া লাগে। এতে এক হাজার টাকা করে খরচ হয়। দিন যেন চলতেই চায় না। এবারের ঝড়ে তাঁর তিনটি ঘরের একটির চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ঝড় শুরুর আগে পুলিশ ও কোস্টগার্ড ওই দ্বীপে গিয়ে সবাইকে নৌ পুলিশ ফঁড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। পরদিন সবাই দ্বীপে ফিরে নিজেদের বাড়িঘর যেন চিনতে পারছিলেন না। অধিকাংশ বাড়িঘর লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

গোলাখালী দ্বীপের হালিমা খাতুনদের মতো মানুষের কষ্ট যেন ফোরায় না। ছবি: মনিরুল ইসলাম
গোলাখালী দ্বীপের হালিমা খাতুনদের মতো মানুষের কষ্ট যেন ফোরায় না। ছবি: মনিরুল ইসলাম

৩০ বছর আগে এই দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য দ্বীপের ২২ বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। ওই জমির ৫–৬ কাঠা করে নওশের, মোমিন আলীরা কিনে বসতি শুরু করেন। তাঁরা আগে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। সেই থেকে তাঁরা ওই দ্বীপে একসঙ্গে বসবাস শুরু করেন।
দ্বীপে কোনো বিদ্যালয় নেই। হাসপাতাল নেই। নেই কোনো বাজার। দ্বীপের অন্তত ৩০ জন ছেলেমেয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে লেখাপড়া করছে। নদীপথে ১১ কিলোমিটার দূরে কালিঞ্চা গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের লেখাপড়া করতে হয়।
নওশের সরদার বলেন, ‘স্কুল থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১৫০ টাকা করে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয়। ওই টাকা স্কুলে আসা-যাওয়ায় নৌকা ভাড়াতেই চলে যায়।’
তাঁরা জানান, এই দ্বীপ গ্রামের নামে কোনো স্কুল-কলেজ বা দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র বরাদ্দ এলেও জায়গা দেওয়ার কেউ হয় না। জায়গার অভাবে অন্য গ্রামে চলে যায়। অথচ দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্রের মতো স্থাপনা এই দ্বীপের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, এখন বছর বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ হচ্ছে। সরকার এদিকে নজর না দিলে একটি জনপদ অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাতক্ষীরা অফিসের নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জী)